সর্বসাধনদুর্লভ তিনি।
তিনি নিজেই নিজেকে রক্ষা করেন। কৃষ্ণ প্রতিষ্ঠা করে দেন, রক্ষা করাটাই যে কল্পনার মায়া। তাঁর রক্ষাকর্তাদের যে তালিকা শুকদেব দিয়েছেন, তাতে রয়েছে তাঁরই নানা নাম। শুকদেবও কি এখানে প্রতিষ্ঠার শর্ত অস্বীকার করে যান? তিনিও কি বলতে চাইছেন, একই পুরুষের এই যে নানা নাম, তাতে তাঁর নানা রূপের হাতে থাকে পৃথক সমস্ত শর্ত। একই পুরুষ তাই ভিন্ন হয়ে যান, তারপরে সেই ভিন্নতার শর্তগুলি নিয়েই রক্ষা করতে আসেন নিজেকেই?
ব্যাসপুত্র শুকদেব বলছেন—‘অজ’ ভগবান তাঁর পদদ্বয় রক্ষা করেন, মণিমান্ জানুদ্বয়, যজ্ঞপুরুষ উরুদ্বয়, অচ্যুত কটিদেশ, হয়গ্রীব উদর, কেশব হৃদয়, ঈশ বক্ষঃস্থল, ইন (সূর্য) কণ্ঠ, বিষ্ণু বাহুযুগল, উরুক্রমমুখ এবং ঈশ্বর তাঁর মস্তক রক্ষা করেন। চক্রী (চক্রধারী) ভগবান তাঁর অগ্রভাগে, গদাধারী শ্রীহরি পশ্চাতে, যথাক্রমে ধনু ও অসি ধারণকারী ভগবান মধুসূদন এবং অর্জুন দুই পার্শ্বে, শঙ্খধারী ঊরুগায় চার কোণে, তার্ক্ষ্য (গরুড়) বাহন উপেন্দ্র ঊর্ধ্বদেশে, হলধর ভূমিতে এবং পরমপুরুষ ভগবান তাঁকে সর্ব দিক থেকে রক্ষা করেন। হৃষীকেশ তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহ, নারায়ণ প্রাণসকল, শ্বেতদ্বীপাধিপতি ভগবান চিত্ত ও যোগেশ্বর মনকে রক্ষা করেন। পৃশ্নিগর্ভ তাঁর বুদ্ধি, পরমাত্মা ভগবান তাঁর আত্মা (অহঙ্কার)কে রক্ষা করেন।
খেলার সময় গোবিন্দ এবং শয়ান অবস্থায় তাঁকে মাধব রক্ষা করেন।
কল্পনার রংয়ের এই উৎসবই কি বৃন্দাবনের দোল?
শুকদেব সেই কল্পনার পরিচয় দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, মহারাজ পরীক্ষিৎ, ব্রজজনের জীবন সার্থক। শুকদেব বিবরণ দিচ্ছেন ব্রজরমণীদের। তারা বলছে, যখন তাঁকে কাছে পায় না, তখন বিরহজ্বালা নিবারণের জন্য কী করে জানিস সখী? তাঁর প্রেমধন্যা ভাগ্যবতী আরাধিকা গোপিকাগণ যখন তাঁর পাদপদ্ম নিজেদের বক্ষে ধারণ করেন, তখন তাঁদের পত্রলেখার কুঙ্কুম গোবিন্দের রক্তিম চরণে সংস্পৃষ্ট হয়ে সুশোভিত হয়, আবার তিনি যখন বনভূমির পথে হেঁটে যান, সেই কুঙ্কুম পথে তৃণাদিতে লগ্ন হয়ে যায়, একান্ত আকুল হয়ে তারা আরাধ্য দেবতার চরণস্পর্শবাহী সেই কুঙ্কুম নিজেদের বুকে মুখে অনুলিপ্ত করে নেয় পরম আগ্রহ যত্নে আদরে ভক্তিতে। এই ভাবেই দূর করে মনের ব্যথা। সর্বসাধনদুর্লভ যিনি, তিনি এঁদের কাছে নিজেকে এ ভাবেই সুলভ করে রেখেছেন। সখী, এরাই কি কৃতকৃত্য নয়? ধন্য নয় এদেরই জীবন?
কৃতকৃত্য নবদ্বীপের জীবনও। চৈতন্যের মধ্যে কৃষ্ণকেই দেখেছিলেন তাঁরা। পরে সেই ধারণার পরিবর্তন ঘটে যায়। বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী আর এক রকম ভাবে ভেবেছিলেন। চৈতন্য কৃষ্ণকে পাওয়ার উপায় বলেও স্থির করা হয়। কিন্তু অন্তত প্রথম দিকে, চৈতন্যকে কৃষ্ণের রূপ বলেই মনে করা হত।
দোল পূর্ণিমার দিনই তাঁর জন্ম। বিমানবিহারী মজুমদার চৈতন্য চরিতের উপাদানে চৈতন্যের জন্ম নিয়ে কে কী বলেছেন, সেই সকল মত ব্যাখ্যা করেছেন।
সে দিন কেউ বলেন শুক্রবার ছিল। কেউ বলেন শনিবার। সে দিন গ্রহণ হয়েছিল। কিন্তু কখন গ্রহণ হয়েছিল, তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। বৃন্দাবনদাস লিখেছেন, ‘ঈশ্বরের কর্ম বুঝিবার শক্তি কার। চন্দ্র আচ্ছাদিল রাহু ঈশ্বর-ইচ্ছায়...হেনই সময়ে সর্ব জগত-জীবন। অবতীর্ণ হইলেন শ্রীশচীনন্দন।।’ বৃন্দাবনকে অনুসরণ করেই কৃষ্ণদাস কবিরাজও লিখেছেন, ‘ফাল্গুন পূর্ণিমা সন্ধ্যায় প্রভুর জন্মোদয়। সেই কালে দৈবযোগে চন্দ্রগ্রহণ হয়।’ পরে লেখা হয়েছিল প্রথমে সন্ধ্যায় চৈতন্যের জন্ম ও পরে গ্রহণ। তিনি লেখেন, ‘সিংহরাশি সিংহলগ্ন উচ্চ গ্রহগণ। ষড়বর্গ অষ্টবর্গ সর্ব সুলক্ষণ।। অকলঙ্ক গৌরচন্দ্র দিলা দরশন। সকলঙ্কে চন্দ্রে আর কোন প্রয়োজন।। এত জানি রাহু কৈল চন্দ্রের গ্রহণ’। বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মত, ‘পূর্ণেন্দুৌ রাহুণা গ্রস্তে সন্ধ্যায়াং সিংহলগ্নকে। নক্ষত্রে পূর্বফাল্গুন্যাং রাশৌ চ পশুরাজকে।। সর্বসল্লক্ষণে পূর্ণে সপ্তকে বাসরে তথা। মিশ্রপত্নীশচীগর্ভাদুদিতো ভগবান হরিঃ।’ নরহরি চক্রবর্তীর কথায়, ‘আজু পূর্ণিম, সাঁঝ সময়ে, রাহু শশী গরাসি, গৌরচন্দ্র উদয়ে তবহি, তাপতম বিনাশি।’
যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি জ্যোতিষ গণনা করে বলেন, রাত ৮ দণ্ডের সময় গ্রহণ আরম্ভ হয়েছিল। অতএব, চৈতন্যের জন্মের সময় ‘পূর্ণেন্দু রাহুগ্রস্ত’ হয় না। তবে সে দিন কত দণ্ড ছিল, তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।
চৈতন্যের বন্ধু ও পার্ষদ মুরারি কী বলছেন? তাঁর কথায়, কৃষ্ণস্বরূপ চৈতন্যের মুখ দেখে লজ্জায় চন্দ্র রাহুতে লুকোয়। তা হলে আগে চৈতন্যের জন্ম, পরে গ্রহণ। চৈতন্যের সমসাময়িক বাসুদেব ঘোষের পদেও একই বার্তা—‘নদিয়া আকাশে আসি উদিল গৌরাঙ্গশশী, ভাসিল সকলে কুতূহলে, লাজেতে গগন শশী মাখিল বদনে মসি, কাল পেয়ে গ্রহণের ছলে।’ কবি কর্ণপুরও লিখেছেন, গ্রহণের আগেই চৈতন্যের জন্ম হয়েছিল।
চৈতন্যকে যে কৃষ্ণ বলেই স্বীকার করে নিত সমসাময়িক নবদ্বীপের সমাজ, তার একটি প্রমাণ তাঁর দোল খেলার বিবরণ। তখনও বিশ্বম্ভর সন্ন্যাস নেননি।
সম্ভবত, বিমানবিহারীর মত, ১৫০৯ সালের কথা। সে দিন দোল খেলেছিলেন বিশ্বম্ভর। সে কথা পরে লেখেন কবি কর্ণপুরের বাবা শিবানন্দ সেন। তিনি লিখছেন, ‘হোলি খেলত গৌরকিশোর। রসবতী নারী গদাধর কোর।। স্বেদবিন্দুমুখে পুলক শরীর। ভাবভরে গলতহি নয়নে নীর।। ব্রজরস গাওত নরহরি সঙ্গে। মুকুন্দ মুরারি বাসু নাচত রঙ্গে।। খেনেখেনে মুরছই পণ্ডিত কোর। হেরইত সহচর ভাবে ভেল ভোর।। নিকুঞ্জ মন্দিরে পঁহু কয়ল বিথার। ভূমে পড়ি কহে কাঁহা মুরলী হামার।। কাঁহা গোবর্ধন যমুনাক কুল। কাঁহা মালতী যুথী চম্পক ফুল।। শিবানন্দ কহে পঁহু শুনি রসবাণী। যাঁহা পঁহু গদাধর তাঁহা রসখানি।।’
পদটি ঐতিহাসিক। বিশ্বম্ভরের প্রথম দিকের পার্ষদ নরহরি, মুকুন্দ, মুরারি, বাসুদেবের প্রত্যক্ষ উল্লেখ রয়েছে পদটিতে। এঁদের সকলকেই শিবানন্দ চিনতেন। সেই তিনি, নন্দকিশোরের ঢঙেই এখানে মহাপ্রভুর কথা বলেছেন। বলেছেন গোবর্থধন পাহাড়, যমুনার কুলের কথা।
কিন্তু সেই টুকুই শেষ কথা নয়। নবদ্বীপে চৈতন্যের তিন প্রধান পার্ষদ তিন ভাই বাসুদেব, গোবিন্দ, মাধব ঘোষ খুবই বিখ্যাত। সেই বাসুদেব একটি পদে কোনও নায়িকার বয়ানে লিখছেন—‘নিশি শেষে ছিনু ঘুমের ঘোরে। গৌর নাগর পরিরম্ভিল মোরে।। গণ্ডে কয়ল সেই চুম্বন দান। কয়ল অধরে অধর রস পান।। ভাঙ্গল নিদ নাগর চলি গেল। অবচেতনে ছিন চেতনা ভেল।।’
এই চৈতন্য নির্ভুল ভাবেই কৃষ্ণ। কল্পনার রংয়ে তৈরি। চৈতন্যের ভিত্তিভূমি মেধা। কিন্তু তিনিও কল্পনার রংকেও স্বীকার করেছেন সেই সূত্রেই। তাঁকে সেই কল্পনার রংয়েই কৃষ্ণ নির্মাণ করে নিয়েছে সমসাময়িক পদ। সর্বসাধনদুর্লভ সাহিত্যের এই শক্তিই কৃষ্ণেরও শক্তি। (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy