Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
শান্তিতে ওয়াকওভার ডোমকলে

রোদ চড়তেই ফাঁকায় গোল

সভাসমিতিতে মেঠো হুঙ্কার ছিল ঠিকই, লড়াইয়ের ময়দানে টঙ্কারটা কিন্তু শোনা গেল না। বরং দিনভর ‘শান্তি’ বজায় রেখে ওয়াকওভার দিয়ে গেল বিরোধীরা।

জখম: ৪ নম্বর ওয়ার্ডে আহত এক জোট-কর্মী। নিজস্ব চিত্র

জখম: ৪ নম্বর ওয়ার্ডে আহত এক জোট-কর্মী। নিজস্ব চিত্র

অনল আবেদিন ও সুজাউদ্দিন
ডোমকল শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৭ ০২:২৯
Share: Save:

সভাসমিতিতে মেঠো হুঙ্কার ছিল ঠিকই, লড়াইয়ের ময়দানে টঙ্কারটা কিন্তু শোনা গেল না।

বরং দিনভর ‘শান্তি’ বজায় রেখে ওয়াকওভার দিয়ে গেল বিরোধীরা।

জোট নেতাদের একাংশের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে কার্যত একতরফা ‘ভোট করিয়ে’ গেল তৃণমূল। রবিবার সকাল থেকে বিরোধী নেতাদের প্রায় খুঁজেই পাওয়া গেল না। দিনের শেষে তাঁরা পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে সন্ত্রাস-রিগিংয়ের জন্য দায়ী করলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে তাঁদের দেউলিয়া দশা লুকোনো গেল না।

মাত্র কয়েক দিন আগে জনকল্যাণ মাঠে সিপিএম-কংগ্রেসের জনসভায় এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বেন না বলে হুঙ্কার দিয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তাতে তুমুল হাততালি দিয়েছিল। পরক্ষণেই অধীর বলেন, ‘‘ভোটের দিন সারা জেলার লোক দিয়ে ডোমকলের চারপাশ ঘিরে রাখা হবে।’’

কোথায় কী? ভোট শুরু হওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায়, জোট কার্যত ‘আত্মসমর্পণ’ করে বসে আছে। ডোমকল ঘেরা দূরের কথা, বেশির ভাগ জায়গায় কোনও পাল্টা প্রতিরোধও দেখা গেল না। বুথে-বুথে কর্মীরা যখন মার খাচ্ছেন, কংগ্রেস অফিস মাছি তাড়াচ্ছে, আর বিজেপি অফিসে ঝুলছে তালা।

ডোমকলে এর আগে পঞ্চায়েত বিধানসভা, লোকসভা থেকে নিতান্ত স্কুলভোটও সন্ত্রাস ছাড়া হয়নি। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএম-কংগ্রেস সংঘর্ষে খুন হন ১৪ জন। গত বিধানসভা ভোটে রাজ্যের কোথাও প্রাণহানি না হলেও এখানে খুন হন সিপিএমের কর্মী তহিদুল ইসলাম। এ বার সেখানে যে খুনোখুনি হল না, তার এক মাত্র কারণ তৃণমূলের দাপাদাপির বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ না থাকা।

গত বিধানসভা ভোটেও তৃণমূলের চোখে চোখ রেখে ভোট করেছিলেন বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা। কিন্তু তার পর এক বছরে অঙ্কটা বদলে গিয়েছে। ওই ভোটে ডোমকল কেন্দ্রে তৃণমূলের সৌমিক হোসেন প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ভোটে হারলেও বিপুল ক্ষমতা নিয়ে রাজ্যের শাসনক্ষমতায় ফিরে আসে তৃণমূল। বিজেপির উত্থানে সিপিএম তথা বামেরা ক্রমশ ক্ষীয়মাণ। আর, কেন্দ্র থেকে তো কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত আরও দু’বছর আগে।

ফলে, সৌমিক হারলেও জোটের পায়ের তলা থেকে মাটি দ্রুত সরছিল। বিধানসভা ভোটের পরে ডোমকলের ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১১টিই দলবদলের জেরে তৃণমূলের হাতে চলে যায়। যে চারটি পঞ্চায়েত নিয়ে ডোমকল পুরসভা গড়া হয়েছে, তার তিনটি এই গোত্রে পড়ে। কংগ্রেসের দখলে থাকা ডোমকল পঞ্চায়েত সমিতিও যায় তৃণমূলের হাতে।

ইতিহাস বলে, বাহুবলীরা বরাবরই শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় মাথা গোঁজে। সিপিএম এবং কংগ্রেস যত ক্ষমতা থেকে দূরে গিয়েছে, দুষ্কৃতীর দল গিয়ে ভিড়েছে প্রভাবশালীদের সঙ্গে। গত বিধানসভা ভোটের পরে ডোমকলের বাহুবলীরাও শাসক দলে নাম লেখায় বলে জানান জেলা পুলিশের এক কর্তা। এমনিতে গ্রামবাংলার প্রচলিত কথা, ‘পঞ্চায়েত যার, ভোট তার।’ গোয়েন্দা দফতরের এক কর্তার মতে, ‘‘গ্রামাঞ্চলে মাস্কেট বাহিনীর লাগাম ধরা থাকে পঞ্চায়েত কর্তাদের হাতে। ডোমকলে মাস্কেটবাহিনীর প্রায় সবাই শাসক দলে ভিড়ে যাওয়ায় জোটের ‘ভোট মেশিনারি’ আর বেঁচে নেই।’’

দলবদলের প্রায় প্রতিটি ঘটনার পরে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে অধীর চৌধুরী দাবি করে এসেছেন, ‘‘নেতারা দল পাল্টালেও কর্মী-সমর্থকেরা কেউ যাননি।’’ জেলা কংগ্রেসের এক নেতা বলেন, ‘‘দাদা (অধীর) ভুল করেছেন। তৃণমূল স্তরের ‘ভোট মেশিনারি মানেই তো পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যরা। তাঁরা চলে যাওয়া মানেই যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেল!’’

সেই ক্ষতিটা বোঝা গেল, যখন সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে ডোমকল থেকে প্রার্থী প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করলেন অধীর। ফলে, ২১ আসনের মধ্যে ১০টিতে কার্যত কোনও লড়াই রইল না। বর্ধমান পুরভোটে প্রার্থী প্রত্যাহারের পরে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিক্রিয়ার কথা মনে রেখে সিপিএম আর সে রাস্তায় যায়নি। কিন্তু, ভোট কতটা কী পেয়েছে, তা তারাই জানে। জোটের ভোট কাটা ছাড়া বিজেপির আর কোনও কার্যকর ভূমিকা ছিল না। কিন্তু সহানুভূতির হাওয়া পালে টানতে ভোট শেষ হওয়ার খানিক আগে তারাও রণে ভঙ্গ দেয়।

প্রত্যাশিত ভাবেই, এত দিন পরে মুচকি হাসছেন সৌমিক হোসেন আর বলছেন, ‘‘নাচতে জানে না, জোটের কাছে উঠোন তো এখন বাঁকা হবেই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rigging Complain Domkol
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE