Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সিন্ডিকেট-রাজ ২

পিস্তল বার করে সটান কপালে তাক

রাজ্যে এসে নরেন্দ্র মোদী দাবি করলেন, এখানে সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেট। কতটা সারবত্তা আছে সেই দাবির? কতটা স্বার্থ জড়িয়ে কার? আর কতটা রাজনীতির মিশেল? খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার।আচমকা দরজা ঠেলে ঢুকল এক ঠিকাদার। একটা কাজ নিয়ে কিছু দিন ধরে তার সঙ্গে বিবাদ চলছে ওই ইঞ্জিনিয়ারের। তা নিয়ে ফের তর্কাতর্কি শুরু হতেই কোমর থেকে পিস্তল বের করে সটান অফিসারের কপালে ঠেকিয়ে দিল সে। কাণ্ড শুনে সকলেই বললেন, পুলিশে জানাতে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহস পেলেন না।

ফাইল চিত্র

ফাইল চিত্র

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৮ ০১:৩২
Share: Save:

আর পাঁচটা দুপুরের মতোই জেলা পরিষদে মানুষের ভিড়। অফিসারেরা ব্যস্ত। এক প্রথম শ্রেণির ইঞ্জিনিয়ার নিজের ঘরে ফাইলে মুখ গুঁজে বসে।

আচমকা দরজা ঠেলে ঢুকল এক ঠিকাদার। একটা কাজ নিয়ে কিছু দিন ধরে তার সঙ্গে বিবাদ চলছে ওই ইঞ্জিনিয়ারের। তা নিয়ে ফের তর্কাতর্কি শুরু হতেই কোমর থেকে পিস্তল বের করে সটান অফিসারের কপালে ঠেকিয়ে দিল সে। কাণ্ড শুনে সকলেই বললেন, পুলিশে জানাতে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহস পেলেন না।

কাজ পাওয়া নিয়ে বিবাদের জেরে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এক ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে ঢুকে প্রবল গালিগালাজ আর ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকিো দেওয়া হয়েছিল। তিনিও ভয়ে অভিযোগ জানাননি। দুই ক্ষেত্রেই সেই ঠিকাদারদের ধরে এনে ক্ষমা চাওয়ানো ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ করতে পারেননি জেলা পরিষদের কর্তারা।

চাকদহে নিম্নমানের কাজ হচ্ছে বলে রিপোর্ট করেছিলেন এক ইঞ্জিনিয়ার। ব্লক অফিসের বাইরে তাঁর উপরে চড়াও হয় ঠিকাদার সিন্ডিকেটের লোকজন। অভিযোগ জানাননি তিনিও। আর প্রতিটা ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে। ‌অফিসারদের একাংশের দাবি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজের মোট টাকার ৫ শতাংশ নিয়ে তাঁরা কাজ ভাগ করে দিচ্ছেন অনুগামী ঠিকাদারদের মধ্যে। তা নিয়ে মাঝে মধ্যেই দলের ভিতরের গন্ডগোল চলে আসছে প্রকাশ্যে। এমনকী, পরস্পরের উপরে চড়াও হতেও দেখা যাচ্ছে। কোটি টাকার লেনদেনের ফলে ফেঁপে উঠছেন নেতারা।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, পাঁচ লক্ষ টাকার বেশি কোনও কাজ হলে তার জন্য ই-টেন্ডার ডাকতে হবে। যে সব চাইতে কম ‘রেট’ দেবে তারই কাজ পাওয়ার কথা। এই খোলা প্রতিযোগিতায় কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বাস্তবে কিন্তু তা-ই হচ্ছে। অফিসারদেরই একাংশ বলছেন, প্রতিটি কাজের জন্য অন্তত তিনটি আবেদন জমা পড়তে হয়। নেতারা ঠিক করে দেন, কাজটা কে করবে। তিনিই বাড়তি দু’টি টেন্ডার জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। স্বাভাবিক ভাবেই, সেগুলির ‘রেট’ যাকে কাজটা পাইয়ে দেওয়া হল তার চেয়ে বেশি।

সিন্ডিকেটের মাথারাই বলছেন, দাদাদের অনুমতি ছাড়া বেশির ভাগ সময়ে কেউ আবেদন করার সাহস পান না। এর বাইরে থেকে কেউ টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যোগ দিলে তার অবস্থা হয় শোচনীয় হয়। কাজ করতে দেওয়া হয় না। তার উপরে মারধরও জোটে। এমনই একটা কাজে হাঁসখালিতে টেন্ডার জমা দিয়েছিলেন কলকাতার এক ঠিকাদার। ছেলের সামনেই মেরে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। চাপড়াতেও শাসক দলের দু’এক জন ছাড়া কারও কাজ পাওয়ার বা পাওয়ানোর অধিকার নেই।

এই পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ জেলার ঠিকাদারদেরই একাংশ। তাঁদের এক জনের আক্ষেপ, “যে ইঞ্জিনিয়ারের মাথায় পিস্তল ধরল, সে দিব্যি কাজ পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। কারণ আমরা মাথায় পিস্তল ধরতে পারছি না।” তবে এখন আর শুধু জেলা পরিষদ নয়, সিন্ডিকেট-রাজ নেমে এসেছে একেবারে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে। কারণ এখন আর ব্লকের মাধ্যমে নয়, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কয়েক কোটি টাকা সরাসরি চলে যায় পঞ্চায়েতের হাতে। ফলে সেখানেও লভ্যাংশের দখল নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দাদারা। তৈরি হয়ে গিয়েছে ঠিকাদারি সিন্ডিকেট রাজ।

যদিও জেলা পরিষদের বিদায়ী সভাধিপতি তৃণমূলের বাণীকুমার রায় বলছেন, “এমনটা একেবারে হয় না, তা বলব না। তবে আমরা অভিযোগ পেলেই পদক্ষেপ করি। জেলা পরিষদের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে যে বা যারা ওই আচরণ করেছিল, তাদের ডেকে পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ানো হয়েছিল।” আইনের পথে হাঁটলেন না কেন? বাণীবাবু বলেন, “আসলে ওঁরাই সেটা চাননি।” কেন, সে কিস্সায় অবশ্য তিনি আর ঢোকেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Syndicate Engineer Threat Gunpoint
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE