Advertisement
E-Paper

নদিয়া আদৌ নির্মল কি, প্রশ্ন তুলল বীরপুর

শৌচালয় তৈরি হয়ে গিয়েছে জানিয়ে আগেই সরকারের কোষাগার থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। অথচ শৌচালয় দূর, একটা ইটের টুকরোও ফেলা হয়নি নাকাশিপাড়ার বীরপুর গ্রামের হুমায়ুন শেখ, গোলাপ শেখদের উঠোনে। রাজ্যের প্রথম ‘নির্মল’ জেলার বাসিন্দা হয়েও গাড়ু হাতে তাঁদের ছুটতে হয় গ্রামের প্রান্তে কিংবা বাড়ির পাশের বাঁশবাগানে।

সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৫ ০১:৪৬

শৌচালয় তৈরি হয়ে গিয়েছে জানিয়ে আগেই সরকারের কোষাগার থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। অথচ শৌচালয় দূর, একটা ইটের টুকরোও ফেলা হয়নি নাকাশিপাড়ার বীরপুর গ্রামের হুমায়ুন শেখ, গোলাপ শেখদের উঠোনে। রাজ্যের প্রথম ‘নির্মল’ জেলার বাসিন্দা হয়েও গাড়ু হাতে তাঁদের ছুটতে হয় গ্রামের প্রান্তে কিংবা বাড়ির পাশের বাঁশবাগানে।

সম্প্রতি বিষয়টি সামনে আসতে নড়েচড়ে বসেছে নদিয়া জেলা প্রশাসন। শুরু হয়েছে তদন্ত। সব দেখে শুনে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘নদিয়াকে কী তবে আদৌ নির্মল জেলা বলা যায়? তা না হলে, কী করে জেলাকে নির্মল ঘোষণা করে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী? কেমন করেই বা সুদূর কলোম্বিয়া গিয়ে ‘সেরার’ পুরস্কার নিলেন জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা?

২০১৩ সালের ২ অক্টোবর থেকে ‘সবার শৌচালয়’ প্রকল্পের মাধ্যমে বাড়িতে পায়খানা নেই এমন পরিবারগুলিকে শৌচালয় তৈরি করে দিতে শুরু করে জেলা প্রশাসন। ২০১৫ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে ৩ লক্ষ ৫৫ হাজার ৬০৬টি শৌচালয় বানিয়ে দিয়ে নদিয়া জেলাকে ‘উন্মুক্ত শৌচবিহীন জেলা’ বলে পুরষ্কৃতও করা হয়। প্রশাসনের দেওয়া এই হিসাবে বিস্তর গলদ রয়েছে বলে প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিলেন বিরোধীরা। এ বার বীরপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে শৌচালয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ সেই অভিযোগকেই মান্যতা দিল বলে মনে করেছেন অনেকেই।

অভিযোগ সামনে এল কী করে?

বীরপুর গ্রামের কিছু বাসিন্দা সম্প্রতি নাকাশিপাড়া ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকের কাছে লিখিত আভিযোগ করেন, ‘শৌচালয় তৈরির নামে তাঁদের নামে টাকা উঠে গেলেও বাস্তবে কোনও শৌচালয় পাননি।’ এঁদেরই একজন হুমায়ুন শেখ। মাস কয়েক আগে স্থানীয় তৃণমূল নেতারা শৌচালয় করে দেওয়ার নাম করে তাঁর কাছ থেকে ন’শো টাকা নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। পরে সেই টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। হুমায়ুনের দিদি সন্ধ্যা বিবির অভিযোগ, ‘‘টাকা ফেরত দেওয়ার বেশ কিছু দিন পরে নেতারা জানান যে আমাদের নামে শৌচালয়ের টাকা আসেনি। তাই শৌচালয় করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরে পঞ্চায়েত থেকে জানতে পারি আমার ভাইয়ের নামে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।’’ একই অভিযোগ বিডিওকে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা গোলাপ শেখ। তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘বিষয়টি পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে বিডিওকে জানিয়েও সুরাহা হয়নি।’’

শুধু হুমায়ুন বা গোলাপ শেখ নয়, এমন অভিযোগ নাকাশিপাড়া ব্লকের বীরপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের বহু মানুষের। এমন ঘটনার কথা মেনেও নিয়েছেন এলাকার বাসিন্দা পঞ্চায়েত সদস্যা তৃণমূলের আসমানি শেখ। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকেই শৌচালয় পায়নি। অথচ তাঁদের নামে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।’’ নাকাশিপাড়া পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সদস্যা লুৎফা বেগমের স্বামী বাবলু শেখ এক ধাপ এগিয়ে বলেন, ‘‘শৌচালয় না থাকায় গ্রামের বহু মানুষ মাঠে যেতে বাধ্য হন। এরপরেও জেলা প্রশাসন কী ভাবে পুরস্কার নিল সেটাই বুঝতে পারছি না!’’

কী করে এমনটা হল? কারাই বা দুর্নীতিতে যুক্ত? বীরপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের আবদুল আজিজ মণ্ডল শৌচালয় তৈরিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে দায়ি করেছেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগও তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘তিনটি সংস্থা শৌচালয় তৈরির কাজ করেছে। সংস্থাগুলির তরফে কোনও অনিয়ম হয়েছে কি না খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ দলের নেতাদের টাকা তোলার অভিযোগও উড়িয় দিয়েছেন তিনি।

শৌচালয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সম্প্রতি বিজেপি-র তরফে পঞ্চায়েতে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। সে দিন পঞ্চায়েত প্রধান শৌচালয় তৈরিতে অনিয়মের কথা মেনে নিয়েছিলেন বলে দাবি করেন বিজেপি নেতারা। দলের জেলা সভাপতি সৈকত সরকার বলেন, ‘‘প্রধান অনিয়মের কথা লিখিত ভাবে স্বীকার করেছেন।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘শুধু বীরপুরেই এমনটা হয়েছে এমন নয়। জেলা জুড়ে এ ভাবেই তৃণমূলের লোকজন টাকা লুটেপুটে খেয়েছে।’’ জেলা প্রশাসন পুরস্কারের লোভে সে সব দেখেও দেখেনি বলে অভিযোগ বিজেপি নেতৃত্বের।

গত ৩০ এপ্রিল কৃষ্ণনগরে এসে নদিয়াকে রাজ্যের প্রথম নির্মল জেলা হিসাবে ঘোষণা করে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘সবার শৌচালয়’ প্রকল্পের জন্য সুদূর কলোম্বিয়ায় গিয়ে ‘২০১৫ ইউনাইটেড নেশনস পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কারও নিয়ে এসেছেন প্রাক্তন জেলাশাসক পিবি সালিম ও সভাধিপতি বাণীকুমার রায়। তথ্যে কারচুপি করে পুরস্কার প্রাপ্তিকে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না বিরোধীরা। জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা সিপিএমের স্বপন ঘোষের মত, ‘‘পুরস্কারের লোভে সত্যকে চাপা দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভুয়ো রিপোর্ট তৈরি করানো হয়ছে। তাল মিলিয়ে শাসক দলের নেতারা কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করেছে!’’

অনিয়মের বিষয়টি কি টের পাননি জেলা পরিষদের কর্তাব্যক্তিরা?

সভাধিপতি বাণীবাবু বলেন, ‘‘নিয়ম হল, শৌচালয় তৈরি হওয়ার পরে ফেসিলেটর বা নির্মাণ সহায়কেরা সার্ভে করে সম্পূর্ণ হওয়া শৌচালয়ের ছবি পাঠানোর পরেই সংশ্লিষ্ট সংস্থা ব্লক অফিস থেকে টাকা পাবেন। এর বাইরে অন্য কিছু হওয়ার কথা নয়।’’ এর অন্য হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। আশ্বাস, তদন্তের কথা শুনিয়েছেন জেলাশাসক বিজয় ভারতীও। তিনি বলেন, ‘‘কিছু অভিযোগ পেয়েছি। সেই মতো তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগ প্রামাণিত হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

সেই প্রতিশ্রুতির দিকে চেয়ে বীরপুরের শৌচালয়হীন পরিবারের সদস্যেরা।

Corruption Noida zila parishad trinamool nakashipara toilet swapan ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy