নোট বাতিলের জেরে এখনও বন্ধ অনেক এটিএম।
মধ্য যামে নোট বাতিলের পরে শহুরে মানুষের হাহাকারের পাশে রাজ্যের গ্রামগুলি ছিল ঈষৎ নীরব।
ভাবখানা— ‘গাঁয়ের’ একান্ত আপন সমবায় ব্যাঙ্ক তো রয়েছে।
সামান্য ক’টা পাঁচশো-হাজারের নোট না হয় দু-পাঁচ কিলোমিটার উজিয়ে সেই সব ব্যাঙ্কেই ভাঙিয়ে আনা যাবে।
প্রথম চার দিনে, তাই দেদার টাকা পড়েছিল ১৭টি জেলার কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের (আরবিআই) হিসেব বলছে, ৫০০ কোটির উপর।
শুক্রবার, সেই গ্রামীণ ভরসাতেই ‘আঘাত’ হানল আরবিআই।
জানিয়ে দিল— সমবায় ব্যাঙ্কে জমা পরা পুরনো পাঁচশো-হাজারে আর লেনদেন হবে না কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে। ফলে জেলার ওই সমবায় ব্যাঙ্কগুলি এখন বাতিল নোটের ভাঁড়ার!
নদিয়ার করিমপুরের সমবায় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলছেন, ‘‘ভাবতে পারেন, ২৬টি কৃষি উন্নয়ন সমবায়ের হাজার ত্রিশেক সদস্য রয়েছে আমাদের। তারা যাবে কোথায়!’’
কোথায় যাবেন তাঁরা?
মুর্শিদাবাদের প্রান্তিক গাঁ-গঞ্জ কিংবা নদিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা এলাকাগুলিতে এ দিনভর ঘুরে ভেঙে পড়া মুখের আবাদি মানুষের মুখোমুখি হওয়া গেল। তাঁদের কেউ বলছেন, ‘‘সাড়ে তিন বিঘা জমি, সম্বৎসরের ধানটা ওই জমি থেকেই তো পাই, এ বার শুখা মরব বাবু!’’ জেলা কৃষি দফতরের এক আধিকারিকও কপালে ভাঁজ ফেলে বলছেন, ‘‘সামনের কৃষি মরসুমে উৎপাদনে ঘোর সঙ্কট দেখা দিতে পারে।’’
সমবায় ব্যাঙ্কের গ্রাহক পরিতোষ বিশ্বাস। বলছেন, “বড় নোট বাতিলের কথা শুনেই পরের দিন চাষের জন্য জমানো দশ হাজার টাকা নিয়ে ওই ব্যাঙ্কে ফেলেছিলাম।
এ বার?’’
নবদ্বীপ কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে প্রতি দিন গড়ে এক কোটিরও বেশি টাকা জমা পড়ে। এই ক’দিনে, সব চেয়ে কম যে দিন জমা পড়েছে, সে দিনও পরিমাণটা ছিল ৮৫ লক্ষ।
ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতির সম্পাদক জয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, “যত দিন গড়াচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা সামনে আসছে। সব দিক সামলে পরিস্থিতি কত দিন সুশৃঙ্খল রাখা যাবে কে জানে!’’
এই হতাশার আবহে ধানতলা কিংবা চাপড়ার বাসিন্দা মদন বিশ্বাস, শ্যামল বিশ্বাসের চোখে চিক চিক করছে আতঙ্ক— ‘‘টাকা ক’টি ফিরে পাব তো!’’ গ্রামের লাগোয়া ওই সমবায় ব্যাঙ্কই ছিল তাঁদের
বুকের বলভরসা। চাপড়া সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক রবীন্দ্র নাথ বিশ্বাস ধরিয়ে দিচ্ছেন, “গ্রাহকেরা কত দিন এটা মেনে নেবেন জানি না!’’
তাঁর গলায় স্পষ্ট আতঙ্ক।
করিমপুরের বালিয়া শিশা সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতিতে অ্যাকাউন্ট রয়েছে মেঘনার কৃষক শিদ্ধেন মন্ডলের। তিনি বলছেন, ‘‘আমার বিঘা দশেক জমি আছে। সর্ষে, কলাই চাষ করি। নোট বাতিলের পরেও ৫৮হাজার টাকা ঋণ শোধ করেছি। এখন ফের ঋণ পাওয়ার কথা। কিন্তু এখন তো হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়ার দশা হল!’’ নদিয়া জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক লিমিটেডের চেয়ারম্যান শীবনাথ চৌধুরি অবশ্য দেগে রাখছেন, “এটা হতে পারে না। প্রয়োজনে আমরা আদালতের যাব।’’
একই সুর মুর্শিদাবাদ জেলা কৃষি সমবায় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার কৃষ্ণপ্রসাদের। বলছেন, ‘‘এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না!’’ তিনি জানান, বহু আবাদি মানুষ আছেন, যাঁদের এই ব্যাঙ্কেই সবেধন। বলছেন, ‘‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক পেট্রোল পাম্পে নোট বদলের অনুমতি দিচ্ছে অথচ সমবায় ব্যাঙ্ককে ভরসা করতে পারছে না, ভাবা যায়!’’
বেলডাঙার সুকুমার ঘোষ, পেশায় গোয়ালা। বলছেন, ‘‘ আমি বাকিতেই দুধ দিচ্ছি। কিন্তু পাওনাদারেরা ছিনে জোঁকের মতো চেপে ধরেছে যে। সমবায় ব্যাঙ্কই ভরসা। এখন
কোথায় যাব!’’ প্রশ্ন সেটাই, ওঁরা যাবেন কোথায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy