Advertisement
২৮ মার্চ ২০২৩

বস্তা খুলতেই মিলল অখাদ্য গুঁড়ো দুধ

চিলিং প্লান্টের কর্মচারি তাঁদের মরিয়া হয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন যে, কোনও ভাবেই তাঁদের প্লান্টে দুধে ভেজাল দেওয়া হয় না। এরই মধ্যে কাঁচুমাচু মুখে এসে হাজির মালিক।

নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৫০
Share: Save:

ফোনে খবরটা পেতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন চিলিং প্লান্টের মালিক সিকেন্দ্র ঘোষ! বুধবার নাকাশিপাড়ার সুধাকরপুর গ্রামে তাঁর প্লান্টে তত ক্ষণে ফুড সেফটি অফিসারকে নিয়ে তল্লাশি শুরু করেছেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক-২ অসিত দেওয়ান।

Advertisement

চিলিং প্লান্টের কর্মচারি তাঁদের মরিয়া হয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন যে, কোনও ভাবেই তাঁদের প্লান্টে দুধে ভেজাল দেওয়া হয় না। এরই মধ্যে কাঁচুমাচু মুখে এসে হাজির মালিক। কিন্তু ফুড সেফটি অফিসারেরে চোখে তখন ধরা পড়ে গিয়েছে চিলিং প্লান্টের ভিতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে একাধিক মাকড়শা! দুধের ছাঁকনিতে জমে আছে ময়লা। যা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে যাওয়া মালিক শেষপর্যন্ত কর্মচারিদের দুষতে শুরু করেছেন।

চিলিং প্লান্টের একধারে অন্ধকারের মধ্যে রাখা ছিল হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের তিনটি বড় খালি ব্যারেল। উপরে টিনের বাক্স আর চট দিয়ে ঢাকা। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে ওখানে ব্যারেলগুলি রয়েছে। সেগুলি টেনে বের করতেই মুখ শুকিয়ে যায় প্লান্টের লোক জনের। আমতা-আমতা করে তাঁরা দাবি করতে থাকেন, ওই ব্যারেলে আসলে জেনারেটরের জন্য ডিজেল আনা হয়। কিন্তু পরীক্ষা করে কোনও ব্যারেলেই এতটুকু ডিজেলের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। আচমকা ডেপুটি সিএসওএইচ-২ অসিত দেওয়ানের চোখ চলে যায় ঘরের বাইরে এক কোণে ছাতা ও প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা সাদা রঙের একটা বস্তার দিকে। সেটা খুলতেই পালিয়ে বাঁচার মত অবস্থা হয় মালিক ও কর্মচারীদের। কারণ, বস্তার ভিতরে রয়েছে নিম্ন মানের গুঁড়ো দুধ! তাঁদের চেপে ধরতেই আমতা-আমতা করে কোনওমতে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন, ‘‘কোনও দুধের ব্যবসায়ী হয়তো বস্তাটা রেখে গিয়েছেন। আমরা জানতে পারিনি!’’ তত ক্ষণে প্লান্টে কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পেরেছেন গ্রামের লোক। তাঁরা এসে ভিড় জমাতে শুরু করেছেন।

ওই চিলিং প্লান্টে যে দুধে ভেজাল দেওয়া হয় সেটা তত ক্ষণে পরিদর্শনে যাওয়া অফিসারদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। দেওয়ালে টাঙানো খাদ্য দফতরের সার্টিফিকেটটাও ভাল করে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, সেটাও ভুয়ো। এর পরই দুধের নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং বাজেয়াপ্ত করা হয় দুধে ভেজাল দেওয়ার সমস্ত উপকরণ। জানিয়ে দেওয়া হয়, আইনানুগ যাবতীয় পদক্ষেপ করা হবে। যদিও তখনও মালিক সিকেন্দ্র ঘোষ দাবি করতে থাকেন যে, তিনি দুধে ভেজাল মেশান না। তাঁর দাবি, “আমি কেবল চাষিদের থেকে দুধ নিয়ে ঠাণ্ডা করে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে পাঠাই। সেখানেই গুণমান সবটা যাচাই করে নেওয়া হয়।”

Advertisement

জেলা জুড়েই ভেজাল দুধ ধরবার জন্য বুধবার জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতর যৌথ অভিযোন শুরু করে। ১২টি ব্লকে ছয় জন ফুড সেফটি অফিসারের নেতৃত্বে অভিযান চলে। আজ বৃহস্পতিবার বাকি পাঁচটি ব্লকে একই ভাবে অভিযান চালানো হবে বলে জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে। এ দিন সুধাকরপুরের প্লান্টের মতো আরও অনেক জায়গায় গিয়েছেন পরিদর্শনকারীরা। তবে স্থানীয় থানার পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে বিশেষ টিম পৌঁছানোর আগেই কোনও ভাবে খবর পেয়ে চিলিং প্লান্ট বন্ধ করে পালিয়েছেন মালিকেরা। ফলে সর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে থাকার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের মধ্যে কেউ বা কারা প্লান্ট মালিকদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

নাকাশিপাড়ায় ষষ্টিতলায় সাধন ঘোষের চিলিং প্লান্টে পৌঁছনোর কিছু ক্ষণ আগেই তাঁরা তালা বন্ধ করে পালিয়ে যান। একই অভিজ্ঞতা হয়েছে চাপড়াতেও। চাপড়ার অন্য একটি চিলিং প্লন্টে হানা নিয়ে দেখা যায়, সেখানে দু-তিন দিনের বাসি দুধ রাখা আছে। সেই প্লান্টের পাশেই একটি আইসক্রিম কলে হানা দিয়ে অভিযানকারীরা দেখেন, সেখানে অস্বাস্থ্যকর জলের সঙ্গে শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় এমন রঙ মিশিয়ে আইসক্রিম তৈরি করা হচ্ছে।

কৃষ্ণগঞ্জের খালবোয়ালিয়ায় দুটি মিষ্টির দোকানেও এ দিন হানা দেওয়া হয়। একটি দোকানে মিষ্টি তৈরিতে পোড়া তেল ব্যবহার করার প্রমাণ মেলে। অন্য একটি দোকানে মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবারের রঙ ব্যবহার করা হয় বলে অভিযানকারীরা জানতে পারেন। পুজোর আগে সব মিলিয়ে গোটা জেলায় এ দিন ২১টি জায়গায় হানা দেওয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে।

জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অসিত দেওয়ান বলছেন, “প্রাথমিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১১-১২টি জায়গায় খাদ্যে ভেজাল পাওয়া গিয়েছে। নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে। রিপোর্ট হাতে পেলেই প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ করা হবে।” জেলাশাসক বিভু গোয়েল বলছেন, “পুজোর সময় দুধের চাহিদা অনেকটাই বেড়ে যায়। তাই বাড়তি লাভের জন্য কোথাও দুধে ভেজাল মেশানো হচ্ছে কিনা সেটা দেখতে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.