Advertisement
০৮ মে ২০২৪

সাঁঝ ঘনালেই পিছু নেয় ওরা

সন্ধ্যার পরে অচেনা হয়ে ওঠে চেনা পথ। আঁধার ভেঙে পড়িমড়ি বাড়ি ফেরার তাড়া। তাতেও কি রেহাই আছে! গর্জে ওঠে ওত পেতে থাকা মোটরবাইক। রাতের গ্রামীণ রাস্তা মেয়েদের জন্য নিরাপদ তো? খোঁজ নিল আনন্দবাজার। সন্ধ্যার পরে অচেনা হয়ে ওঠে চেনা পথ। আঁধার ভেঙে পড়িমড়ি বাড়ি ফেরার তাড়া। তাতেও কি রেহাই আছে! গর্জে ওঠে ওত পেতে থাকা মোটরবাইক। রাতের গ্রামীণ রাস্তা মেয়েদের জন্য নিরাপদ তো? খোঁজ নিল আনন্দবাজার।

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:৫৫
Share: Save:

ঝুপ করে নেমে এল শীতের সন্ধ্যা।

ট্রেনের কামরায় বসে বার বার ঘড়ি দেখেন বছর তেইশের এক তরুণী। সবে সাড়ে পাঁচটা। অথচ এর মধ্যেই নিকষ অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে চরাচর। আর একটা স্টেশন পরেই চেনা গন্তব্য। বড়জোড় আর মিনিট সাতেক সময় লাগবে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠছেন অফিস ফেরত ওই তরুণী। প্ল্যাটফর্মে কোনও সমস্যা নেই। বিস্তর লোকজন, আলো, হইচই। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথ তো অন্ধকারে ডুবে রয়েছে।

সেই আঁধার ভেঙে তিনি নিরাপদে বাড়ি পৌঁছতে পারবেন তো?

আজও কি অন্ধকার ফুঁড়ে পিছু নেবে বেয়াড়া মোটরবাইক?

আজও কি সেই অশ্লীল মন্তব্য, চটুল গান ও কটূক্তি?

আজও কি সেই অপমানিত হয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে বাড়ি ফেরা?

মাঘের কনকনে ঠান্ডাতেও তরুণীর কপালে বিনবিনে ঘাম। প্ল্যাটফর্মে নেমেই তিনি বিড়বিড় করেন, ‘‘টিভির পর্দায় উন্নয়নের ফিরিস্তির শেষ নেই। আর রাস্তায় পুলিশি টহল তো দূর অস্ত, একটা আলোর ব্যবস্থা পর্যন্ত করতে পারে না!’’

তরুণীকে কি চেনা চেনা ঠেকছে? কিংবা এলাকাটা? সন্ধ্যার পরে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের প্রায় যে কোনও বাসস্ট্যান্ড কিংবা রেল স্টেশনে গিয়ে দাঁড়ান, এমন অসংখ্য মহিলাদের খুঁজে পাবেন। কেউ অফিস থেকে ফিরছেন, কেউ টিউশন নিয়ে কিংবা কেউ নিজের কাজ সেরে। কমবেশি প্রত্যেকেই ভীত তাঁদের বাড়ি ফেরা নিয়ে।

কারণ সেই আঁধার পথেই ওত পেতে থাকে বিপদ। চুরি, ছিনতাই, দুর্ঘটনা যে একেবারেই হয় না তা নয়। তবে তার থেকেও বেশি ভয় রোমিওদের মোটরবাইকের। তাদের দৌরাত্ম্যে সন্ধ্যার পরে একা পথ চলাই দায় হয়ে পড়ছে মহিলাদের। একা কেন, সঙ্গে কেউ থাকলেও কি বিপদ এড়ানো যাচ্ছে?

দিন কয়েক আগে কালীগঞ্জ-দেবগ্রাম রাজ্য সড়কে স্কুটিতে দাদার সঙ্গে বা়ড়ি ফিরছিলেন দুই বোন। পিছু নিয়েছিল একটি মোটরবাইক। কখনও এগিয়ে, কখনও কাছাকাছি, কখনও আবার পিছন থেকে দুই বোনের মুখে তীব্র আলো ফেলে নাগাড়ে বিরক্ত করছিল তিন রোমিও। তাদের সেই দৌরাত্ম্য এড়াতে স্কুটির গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কালীগঞ্জের শ্যাওড়াতলার বাসিন্দা গোলাম মোর্তাজা (৩৬)।

বিপদ বুঝে দুই বোন সিঁটিয়ে বসে ছিলেন স্কুটির পিছনের সিটে। তা দেখে আরও মজা পেয়ে যায় রোমিওরা। বাইক ছুটিয়ে তারা সটান ধাক্কা মারে স্কুটিতে। রাস্তায় ছিটকে পড়ে মারা যান গোলাম। পুলিশ তিন যুবককে গ্রেফতারও করেছে। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফের রোমিও-দৌরাত্ম্য শান্তিপুরে। এ দিন সন্ধ্যায় কম্পিউটর ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন স্থানীয় কলেজের এক ছাত্রী। মোটরবাইকে তাঁর পিছু নেয় দু’জন।

বিপদ বুঝে সাইকেলে গতি বাড়ান তিনি। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরেই সাইকেল থেকে পড়ে যান। টাল সামলাতে না পেরে বাইক নিয়ে পড়ে যায় ওই দুই যুবকও। ছাত্রীর চিৎকারে ছুটে আসেন স্থানীয় লোকজন। তাঁরাই ওই তরুণীকে উদ্ধার করে দুই রোমিওকে আটকে রাখে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

তবে দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সবসময় কিন্তু থানা-পুলিশও হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহু মহিলাই মুখ বুঁজে সহ্য করেন এই অত্যাচার। পুলিশ তো দূরের কথা, এমন ঘটনা বাড়িতেও জানাতে চান না অনেকে। ভুক্তভোগী এক তরুণী বলছেন, ‘‘সন্ধ্যার পরে ফেরার জন্য এমনিতেই বাড়িতে সমস্যা হয়। এ সব কথা জানতে পারলে তো আর চাকরিটাই করতে দেবে না।’’ আর এক অভিভাবকের যুক্তি, ‘‘সব চেনেও ভয়ে চুপ থাকতে হয়। ওই রাস্তা দিয়েই তো কাল আবার মেয়েকে বাড়ি ফিরতে হবে। থানা-পুলিশ করলে যদি ওরা যদি বদলা নেয়!’’

জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় রোমিওরা। অন্য সময় ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ স্লোগান তারা ভুলে মেরে দেয়। কিন্তু সন্ধ্যার পরে নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে সেই তারাই হেলমেট পরে এমন দৌরাত্ম্য করে বেড়ায়। নদিয়ার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলছেন, ‘‘সন্ধ্যার পরে রাস্তায় পুলিশি টহল বাড়ানো হচ্ছে।’’ আর মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশের এক কর্তার পরামর্শ, ‘‘এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কন্ট্রোল রুম অথবা ১০০ ডায়াল করুন। সঙ্গে রাখতে পারেন মরিচ গুঁড়োও।’’

জেলাসদর থেকে প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জে এমন ঘটনা ক্রমে বেড়েই চলেছে। তারপরেও রাস্তায় দেখা মেলে না পুলিশের। আঁধার পথও আঁধারই থেকে যায়।

(তথ্য সহায়তা— সামসুদ্দিন বিশ্বাস, সুস্মিত হালদার ও সুজাউদ্দিন)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Woman Girls Village Night life
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE