জাল বুনছেন জিতু মণ্ডলেরা। — নিজস্ব চিত্র
আকাশে মেঘ ডাকলেই মন আনচান করে জিতু মণ্ডলের। বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা ছেঁড়া জালটা নামিয়ে তিনি বসে পড়েন মেরামত করতে। কিন্তু মাছ ধরাই যেখানে শিকেয় উঠেছে তখন জাল নিয়ে কী হবে? আকাশের মতোই মুখটা ভার হয়ে যায় বৃদ্ধের। বলেন, ‘‘ওই যে কত্তা, ম্যাঘ ডাকল কি না! এত কালের অভ্যেস তো।’’
পদ্মার গতিপথ বদলে গিয়েছে। রানিনগরের গুড়ি সম্প্রদায়ের জীবিকার অভিমুখও পাল্টে গিয়েছে। তবুও বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে চলে আসা জীবিকা তাঁদের টানে। সেই টানেই তাঁরা পুরনো বছরের ছেঁড়া জাল মেরামত করতে বাড়ির দাওয়ায় বসে পড়েন। পদ্মার বুকে স্মৃতির জাল ফেলে উঠে আসে কত কথা। কত কাহিনি। মনে পড়ে জালের ফাঁসে রুপোলি ইলিশের ছটপটানি। আড়, রিঠা, খয়রা, পাবদা, গলদার কথাও।
রানিনগরের মোহনগঞ্জ-গুড়িপাড়ার বাড়ির দাওয়ায় ছেঁড়া জাল মেরামত করতে বসে বিড়বিড় করছেন জিতু, ‘‘ওই যে নামুটা দেখছেন, হ্যাঁ, ঠিক ওইখানে পদ্মা ছিল। তারপর পদ্মাও সরে গেল। গুড়ি জাতটাও শেষ হয়ে গেল।’’ গুড়ি সম্প্রদায়ের পেশা মাছ ধরা। পদ্মা ওপারে বাংলাদেশে সরে যাওয়ায় মাছ ধরার বদলে গুড়িপাড়ার এখন দিন চলে রাজমিস্ত্রির কাজ করে, ইটভাটায় দিনমজুরি করে, রিকশা চালিয়ে কিংবা হোটেলে রাঁধুনির কাজ করে। জীবনের উপান্তে দাঁড়িয়ে জিতু মণ্ডল তাই বলছেন, ‘‘জাতকর্মটাই যেখানে ডুবতে বসেছে সেখানে জাতটা আর থাকল কোথায়!’’
আষাঢ় থেকে আশ্বিন— এই চার মাস রাজশাহী থেকে গুড়িপাড়ার পাড় পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পদ্মায় জলের একটানা বিস্তার। সেই জলে নাও ভাসাবে গুড়িপাড়া। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটবে। সম্বচ্ছরের বদলে তিন মাস তাঁরা পদ্মায় পড়ে থাকবেন মাছের খোঁজে। তারপর ফের অন্য পেশা খুঁজে নেওয়া। স্থানীয় কাতলামারি ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য দ্রৌপদী মণ্ডল জানাচ্ছেন, পদ্মা সরে যাওয়ার পরেই অনেকেই পুরনো পেশা বদলে ফেলেছেন। গুড়ি সম্প্রদায়ের ৪০০ পরিবার বাপ-ঠাকুরদার জীবিকা খুইয়ে কেউ দিনমজুরি করেন, কেউ ঠেলেন রিকশা।
কিন্তু গুড়ি সম্প্রদায়ের মহিলারা যাঁরা একসময় গেরস্থালি সামলে জাল বুনে স্বামী-সন্তানদের সাহায্য করতেন, তাঁরা কী করছেন? কাতলামারি ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের মহম্মদ মোল্লা বলছেন, ‘‘গুড়িপাড়ায় মহিলারা স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়েছেন। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে জাল বুনে বিক্রি করছেন।’’ গুড়িপাড়ার ‘মা সারদা স্বনির্ভর গোষ্ঠী’র নেত্রী সাগরি মণ্ডল বলেন, ‘‘জাল বুনছি ঠিকই। কিন্তু বিক্রি তো হয় মোটে ৩ মাস।’’
গুড়িপাড়ার দীনেশ মণ্ডল বলছেন, ‘‘তারপর আর কী? এখানে কাজ না থাকায় দিল্লিতে রিকশা চালাই। সামনে বর্ষা। তাই মাস তিনেকের জন্য বাড়ি ফিরেছি। আগের মতো পদ্মায় সারা বছর জল থাকলে কী আর আমাদের এই দশা হত?’’ বংশানুক্রমিক পেশা থেকে মন সরাতে না পেরে গুড়িপাড়ার বেশ কয়েক জন বাড়ি থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে ফরাক্কা, ধুলিয়ান, অরাঙ্গাবাদের গঙ্গায় মাছ ধরতে যান। স্থানীয় বাসিন্দা দ্বীজেন্দ্রনাথ মণ্ডল যেমন বলেন, ‘‘সেখানে এক নাগাড়ে ১০-১২ দিন মাছ ধরার পর ওঁরা একদিনের জন্য বাড়ি ফেরেন। তবে সকলেই যে সে পথে হাঁটে এঅমন নয়। আমার ছেলেই যেমন। সে দিল্লিতে রাজমিস্ত্রির কাজ করছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy