প্রতীকী ছবি।
বিদেশে কাজে যাওয়ার জন্য এজেন্টকে দিতে হয়েছিল ৭৫ হাজার টাকা। কিন্তু ফিরতেও যে টাকা লাগবে, তা ভাবতে পারেননি বছর তিরিশের অমিত বিশ্বাস। ভাবতে পারুন বা না পারুন, তাঁর পরিবার টাকাটা এজেন্টের হাতে তুলে দেওয়ার পরেই মিলেছিল ফেরার ছাড়পত্র।
হবে না-ই বা কেন? তাঁকে যে মালয়েশিয়ার নির্মাণ কাজে যুক্ত এক ঠিকাদারের কাছে ‘বিক্রি’ করে দেওয়া হয়েছিল। ‘ফিরব’ বললেই কি আর ফেরা যায়? সেই ঠিকাদারকে টাকাটা ফিরিয়ে না দিলে ছাড়বে কেন? শেষে ৭২ হাজার টাকা দিয়ে মেলে মুক্তি!
কোমরে অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে দিন দশেক আগে হাঁসখালির মুড়াগাছার বাড়িতে ফিরেছেন অমিত। বাড়ির উঠনে লতিয়ে থাকা লাউডগায় পরম মমতায় হাত বোলাতে বোলাতে তিনি বলেন, “এজেন্ট আমাদের মোটা টাকা বেতনের নাম করে মালয়েশিয়ায় নিয়ে গিয়েছিল। যে সংস্থার নাম বলেছিল, ওখানে তেমন কোনও সংস্থা নেই। ওরা আসলে আমাদের ১৪ জনকে চিনের এক জনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। পরে জানতে পারি, প্রত্যেকের জন্য ৮৫ হাজার টাকা করে নিয়েছিল।” অমিতের সঙ্গেই মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন গ্রামেরই আর এক যুবক প্রসেনজিৎ পাইক। দু’জনেই চড়া সুদে টাকা ধার করেছিলেন। প্রসেনজিতের পরিবার অত্যন্ত গরিব। তাঁর মা টাকা জোগাড় করতে পারছেন না বলে তাঁকে ঘরে ফেরাতে পারছেন না। নতুন করে টাকা ধার করতেও পারছেন না। দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধা। রবিবার তিনি বলেন, “প্রায় দিনই ও ফোন করে কান্নাকাটি করে। কিন্তু টাকাটাই জোগাড় করতে পারছি না যে!”
তাঁদের অভিযোগ, যত বেতন দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক কম দেওয়া হচ্ছে। খাওয়ার খরচ নিজের। চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা নেই। কাজে একটু এ দিক-ও দিক হলেই জুটছে মারধর। অমিত বলেন, “যাওয়ার কিছু দিন পরেই প্রচণ্ড কোমরে ব্যাথা। সেই সঙ্গে ধুম জ্বর। কিন্তু কিছুতেই ওরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল না। পড়ে থাকলাম ওই ভাবে।”
বছর তিন-চারেক ধরেই এমন অভিযোগ আসতে শুরু করেছে নানা জায়গা থেকে। যে কাজের নাম করে বিদেশে পাঠানো হয়েছে, সেই কাজ মেলেনি। বেতনও দেওয়া হয়নি আশ্বাস মতো। কোথাও প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ দেওয়া নাম করে লাগানো হয়েছে ঘাস কাটার কাজে। কেউ পেয়েছেন উট চরানোর কাজ। রাজমিস্ত্রির কাজের নামে নিয়ে গিয়ে বাসন মাজার কাজ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রথমে নিয়ে নেওয়া হয়েছে পাসপোর্ট। ফলে চাইলেও কেউ ফিরে আসতে পারেননি।
মূলত অভাবের কারণে এই ঝুঁকির পথে পা বাড়ান নদিয়ার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটু ভাল থাকার আশায়। এঁদের বেশির ভাগই হয় দিনমজুর না-হয় কাঠের বা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তাদের আক্ষেপ, এখানে সারা বছর কাজ পাওয়া যায় না। মজুরিও অনেক কম।
বছর কয়েক ধরে বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের কড়াকড়ির কারণে চোরাচালানও প্রায় বন্ধ। তার জেরেও সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় বহু মানুষের রোজগার কমেছে। আগে চোরাচালানে যুক্ত ছিল, এমনও কেউ কেউ মোটা টাকার লোভে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।
ভাগ্যান্বেষণে যাওয়া এই সব মানুষদের আশা থাকে, বছর পাঁচেক বিদেশে কাজ করতে পারলে যে টাকা জমবে, তা নিয়ে ফিরে এসে দোকান বা অন্য কোন ব্যবসা খুলে বসবেন। এদের অনেকেই হয়তো ভাল থাকেন। ঠিকঠাক চলে সবটাই। কিন্তু যাঁরা ফড়ে বা দালালদের ফাঁদে পা দিয়ে সরাসরি যেতে চান, তাঁরা অনেকেই বিপদে পড়েন। কেননা ওই দালালেরা সরাসরি কোনও সংস্থায় নয়, নানা দেশের ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে লোক পাঠায়। ফলে কাজের বা বেতনের কোনও নিশ্চয়তা থাকে না।
তার উপরে মোটা টাকায় বিক্রির অভিযোগ তো আছেই। দাস ব্যবসারই যেন এক নতুন মূর্তি! (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy