Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Illegal Gold Traders

ধনতেরসে ‘রেকর্ড’ সোনা পাচার বাংলায়! হলুদ ধাতুর কালো কারবারের খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন

ধনতেরসের আগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শহর-মফস্সলের গয়নার দোকানে পৌঁছে গিয়েছে চোরাই সোনা। কেমন সেই কারবার? কী ভাবে হয় পাচার? কী বলছে প্রশাসন?

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

প্রণয় ঘোষ
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:৫৪
Share: Save:

সপ্তাহ দুই যা ধকল গেল! রবিবার শুধুই জিরিয়ে নেওয়ার সময়। ‘অর্ডারের মাল’ পাঠাতে গিয়ে অনেক হ্যাপা পোহাতে হয়েছে। অভিজ্ঞতা, হাতযশ আর মুন্সিয়ানায় কোথাও কোথাও অনায়াসেই কাঁটাতার টপকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে ‘মাল’। কোথাও কোথাও সীমান্তরক্ষী এবং পুলিশের শ্যেন দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব হয়নি। গচ্চা গিয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার ‘হলুদ ধাতু’। এখন ‘সাফল্য’ আর ‘ব্যর্থতা’র বিচারের সময়। চলছে আর্থিক লাভ-ক্ষতির অঙ্ক মিলিয়ে কতটা মুনাফা ঢুকল পকেটে, তার হিসেব। ধনতেরসে যখন জায়গায় জায়গায় গয়নার দোকানে উপচে পড়ছে ভিড়, তখন এঁদের ব্যস্ততাও কম ছিল না। এঁরা সোনার চোরাকারবারি!

গত বারের তুলনায় এ বার ধনতেরসে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ সীমান্ত দিয়ে গড়ে রেকর্ড পরিমাণ সোনা পাচার করেছেন তাঁরা। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, এ বার ধনতেরসে সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকেছে ২২ কেজি কাঁচা সোনা। যা গত বারের চেয়ে ৭ কেজি বেশি। গত দু’ বছর ধনতেরসে বাংলাদেশ তথা আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দামের খুব বেশি ফারাক না থাকায় ‘ব্যবসা’ সে ভাবে হয়নি কারবারিদের। সব মিলিয়ে ‘মাত্র’ ১০ কেজি সোনার ‘ব্যবসা’ হয়েছিল ধনতেরসের দুই সপ্তাহে। তাই, এ বার ‘মিশন সাকসেসফুল’ না হলেও মোটা অঙ্কের লাভ এই চোরাকারবারিরা তুলে ফেলেছেন।

এঁদের কাজটা কেমন?

ভারত- বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে চোরাপথে এ দেশের বাজারে সোনা পাচার হয়। বাংলার বাজারে তুলনামূলক চড়া দামে ভিয়েতনাম এবং মায়ানমারের সোনা বিক্রির বিরাট চক্র চালান কিছু কারবারি। এঁদের ব্যস্ততা কয়েক গুণ বেড়ে যায় ধনতেরসে। প্রতি বছরই এই দিনে বাড়তি চাহিদা থাকে ভারতে। তাই পাচারের চেষ্টাও চলে জোরদার। বিএসএফ এবং রাজ্য শুল্ক দফতরের নজরদারি এড়িয়ে সোনা নিয়ে পৌঁছনো এখন অনেক ঝক্কির। তবু চেষ্টায় খামতি নেই।

‘‘বছর দশেক আগেও এ সবের বালাই ছিল না। কাজ অনেক ‘স্মুথ’ ছিল।’’ এমনটাই দাবি এক পুরনো অবৈধ সোনা কারবারির। যদিও প্রবীণের দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন নবীন কারবারি। সোনা পাচারের কাজে সদ্য হাত পাকানো ওই বাংলাদেশি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘নজরদারি যত বেড়েছে, ব্যবসাও তত বেড়েছে।’’ তাঁর দাবি, বাংলাদেশের সোনা পাচারকারীরা এ বার বেশ মোটা অঙ্কের মুনাফা পকেটে পুরতে পেরেছেন। ধনদেবতা এ বার তাঁদের নিরাশ করেননি।

নিরাশ হননি এ দেশের কারবারিরাও। সীমান্ত থেকে শহর কিংবা মফস্সলের সোনার দোকানে চোরাই ধাতু পৌঁছে দিয়ে মোটা অঙ্কের মুনাফা পেয়েছেন তাঁরা। ধনতেরসে সোনা চোরাকারবারিদের হাসি চওড়া হয়েছে। বাংলাদেশের একটি সূত্রের খবর, সেখানে অবৈধ ভাবে পৌঁছনো ২৪ ক্যারাটের খাঁটি সোনার মূল্য তিন থেকে তিন লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা প্রতি ১০০ গ্রামে। ভারতের বাজারে যে সোনার মূল্য ছয় লক্ষ টাকার বেশি। সুতরাং, ঝক্কি আর ঝুঁকি একটু বেশিই। সীমান্তের প্রহরা সামলে শুল্ক দফতরের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেই মুনাফা কয়েক লক্ষ টাকা। কিন্তু, ধরা পড়লে? ‘কারবারিরা’ হেসে বলছেন, ‘‘লাভ-লোকসান তো ব্যবসার অঙ্গ। ক্ষতি হলে তো আর ব্যবসা তুলে দেওয়া যায় না। বরং নতুন ‘প্ল্যান’ খাটাতে হয়।’’

পরিসংখ্যান বলছে, গত এক সপ্তাহে বিএসএফের হাতে ধরা পড়েছে ৩ কেজিরও বেশি সোনা। ৬০০ গ্রামের কাছাকাছি সোনা বাজেয়াপ্ত করেছে শুল্ক দফতর। গ্রেফতার হয়েছেন তিন জন।

বাংলাদেশের মুজিবনগরের সোনা কারবারের অন্যতম হুন্ডি হামিদুলের কথায়, ‘‘এ বার ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা এবং মায়ানমারের সোনা ধনতেরসের বাজারে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা প্রতি ১০ গ্রাম হারে পাওয়া গিয়েছে।" আত্মবিশ্বাসের সুরে হামিদুল বলে চলেন, ‘‘সীমান্তের ও পারে আমরা ৪৫ থেকে ৪৭ হাজারে ওই সোনা বিক্রি করেছি। বেশ কিছু ধরা পড়লেও সে সব ক্ষতি বাদ দিয়ে লাভ ভালই হয়েছে।’’

ভারতের অবৈধ সোনা কারবারের সঙ্গে যুক্ত অন্যতম কারবারি নদিয়ার রানাঘাটের সুবীর সাহা (নাম পরিবর্তিত) বলেন, ‘‘এ বার সোনার দাম খুব বেশি থাকায় এ বার বাংলাদেশি সোনার খুব চাহিদা ছিল। বিএসএফ, কাস্টমস্ সামলে সোনা আনা খুব মুশকিল। তবুও এ বার ব্যবসা ভালই হয়েছে।’’

বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী সমিতির দাবি, সোনার উপর কেন্দ্রীয় সরকার আমদানি শুল্ক এবং জিএসটি-র হার অনেকটা বাড়িয়েছে। ফলে বাজারে সোনার দাম অনেকটা বেড়েছে। যার জেরে সোনার চোরাবাজার এবং বৈধ বাজারের দামের মধ্যে ব্যাপক ফারাক। গয়না ব্যবসায়ীদেরই কেউ কেউ লোভের বশে ওই সব চোরাবাজার থেকে সোনা কেনার চেষ্টা করছেন। অন্য দিকে চাহিদা দেখে উৎসাহিত হয়ে পড়েছেন সোনা পাচারকারীরাও। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চোরাপথে ভারতে সোনা পাচার চলছে।

দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মায়ানমার এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে চোরাই পথে সোনা পৌঁছে যায় বাংলাদেশে। এই লেনদেনে জড়িত থাকেন ‘হুন্ডি’রা। বাংলাদেশ পুলিশের একটি সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সে দেশে এই মুহূর্তে ৩২টি সোনা পাচারের র‍্যাকেট প্রবল সক্রিয়। ঢাকা থেকে যশোরের চোরাচালান সিন্ডিকেটগুলোর হাতে পৌঁছে যায় চোরাই সোনা। তার পর সেগুলো ‘ক্যারিয়ার’দের সাহায্যে সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পৌঁছে যায়। এক বার পাচারের জন্য ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা করে পান ওই ‘ক্যারিয়ার’রা।

সোনা পাচারের এই বাড়বড়ন্ত সম্পর্কে অবগত প্রশাসন। চলছে ধরপাকড়ও। এ নিয়ে বিএসএফের দক্ষিণ বঙ্গ ফন্টিয়ারের ডিআইজি (জনসংযোগ) একে আর্য বলেন, ‘‘গত দু’দিন আগেও প্রায় এক কেজি সোনা-সহ এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দু’ সপ্তাহের মধ্যে বেশ কিছু সোনা উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে।’’ তিনি জানান, ধনতেরসের কথা মাথায় রেখে বাড়তি নজরদারি রাখা হয়েছিল সীমান্তে। আর জঙ্গিপুর পুলিশ জেলার সুপার আনন্দ রায়ের কথায়, ‘‘সব সময়ে সোনা পাচারের বিরুদ্ধে সজাগ দৃষ্টি থাকে জেলা পুলিশের। তবে, সব ক্ষেত্রেই ক্যারিয়াররা গ্রেফতার হয়। চক্রের মূল পাণ্ডাদের গ্রেফতারের লক্ষ্য নিয়ে এ বার অভিযান চালাচ্ছি। আশা করছি, সাফল্য মিলবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE