Advertisement
০৫ মে ২০২৪
সঘন বরষায় ৪

মেঘমুলুকের গল্প শোনায় নদীর জল

দারুণ দহন অন্তে সে এসেছে — ভরা নদী, স্কুল-ছুটি, চপ-মুড়ি বা নিঝুম দুপুর-রাতে ব্যাঙের কোরাস নিয়ে সঘন বরষা রয়েছে কি আগের মতোই? কিছু প্রশ্ন, কিছু স্মৃতি নিয়ে সেই কাদা-জলে পা রাখল আনন্দবাজার। দারুণ দহন অন্তে সে এসেছে — ভরা নদী, স্কুল-ছুটি, চপ-মুড়ি বা নিঝুম দুপুর-রাতে ব্যাঙের কোরাস নিয়ে সঘন বরষা রয়েছে কি আগের মতোই? কিছু প্রশ্ন, কিছু স্মৃতি নিয়ে সেই কাদা-জলে পা রাখল আনন্দবাজার।

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।

অনল আবেদিন ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৭ ০৯:৩০
Share: Save:

ধনপতি সওদাগর বাণিজ্যে চলেছেন সিংহল দ্বীপ। হাতের তেলোর মতো বাংলার নদী-নালার সঙ্গে আলাপই তাঁকে বাংলা-বাণিজ্যে আলাদা জায়গা করে দিয়েছিল। সিংহলের পথেও সেই খাঁড়ি-নদী-সমুদ্রে বুক বেঁধে ভেসে পড়েছিলেন তিনি। সেই বণিক সারাক্ষণ ছুঁয়ে থাকতেন নদীকে। রাত্রিবাস করতেন তীরে। এমনই এক রাতে ‘নয় দীয়ার’ তীরে বসে শুনেছিলেন সংখ্যাহীন নদীস্রোত থেকেই কী ভাবে এই জায়গার নাম নদিয়া হয়েছিল। জেনেছিলেন, জনপদের এক নদী, ‘অলকানন্দা’ হারানোর বেদনা থেকে কেমন করে নদীকে সন্তান স্নেহে আগলে রাখার ইচ্ছে জন্মেছিল নদিয়াবাসীর মনে।

পনেরো শতকের মাঝামাঝি লেখা কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল থেকে স্পষ্ট নদী হারানোর শুরুটা মধ্যযুগেই। হারানোর যন্ত্রণা থেকে নদিয়া শিখেছিল কেমন করে বর্ষার জল দিয়ে জিইয়ে রাখতে হয় নদীকে। ‘ধনপতির সিংহল যাত্রা’য় রামকুমার মুখোপাধ্যায় শুনিয়েছেন সে অভিজ্ঞতাও, “খালবিল, নালা-জলা একাকার, গুড়গুড়িয়া ঘোরোস্রোত চলে নগরভ্রমণে, পাগলাচণ্ডী যায় পথ পরিক্রমায়। রূপবতী অঞ্জনা স্রোত প্রহরে প্রহরে রূপ বদলায়। কখনও ময়ূরাঞ্জন, কখনও শ্রীকর, কখনও ফণী, নীল নীরদ— সে শ্রাবণ বর্ষণে দেশান্তরী। সবাই ফেরে ভাদ্র-সংক্রান্তির শীতল অন্ন-ব্যঞ্জনে, কেউ উমার সঙ্গে মহাবোধনে। হারিয়ে যায় একজনা, এক কুমারী...অলকানন্দা হারিয়েছে, গাঙ্গনি, খড়িয়া, জলঙ্গি হারাতে চায় না জনপদবাসী। পৌষ সংক্রান্তিতে ধান্যগাছার বেড়িতে বাঁধে মাথাভাঙ্গা, চূর্ণি, ইছামতি, ভৈরবে।”

কিন্তু স্নেহের বাঁধনে নদীকে বেঁধে রাখতে পারেনি মানুষ। ধনপতির যাত্রাপথের সেই সব নদীর বেশির ভাগই হয় হারিয়ে গিয়েছে কিংবা হারানোর পথে। একে একে হারিয়েছে অঞ্জনা, গুড়গুড়ে। ভাগের মা হয়ে গঙ্গা বইছে বহু যন্ত্রণা নিয়ে। ধুঁকছে জলঙ্গি, চুর্ণি, পাগলাচণ্ডী, ইছামতী, ভৈরব, মাথাভাঙা। কাঠফাটা গ্রীষ্মে সে নদীকে নদী বলেই চেনা দায়। কোথাও নদীর বুকে গড়ে ওঠে রাস্তা, কোথাও চাষ হয় ধান, পাট। আকাশে মেঘ জমলে শিহরিত হয় নদী। সঘন বর্ষায় শীর্ণ দেহে ফেরে প্রাণের স্পন্দন। শুখা নদীতে শব্দ ওঠে ছলাৎছল। ঘোলা জল তখন গল্পের ঝাঁপি খুলে বসে ঘাটের কাছে। নদী পারের জনপদও স্মৃতি হাতড়ায়। মরা নদীর সোঁতায় ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে হারিয়ে যাওয়া মুখ। নদী জেগে উঠলেই যাঁদের কথা বড্ড মনে পড়ে। তেমনই একজন কাইমুদ্দিন শেখ। রানিনগরের পানিপিয়া-নজরানা গ্রামের হতদরিদ্র কাইমুদ্দিন মারা গিয়েছেন বেশ কয়েক দশক আগে। প্রতি বর্ষায় ধান, পাট কাটার মরসুমে দৌলতাবাদ থানা এলাকার বিভিন্ন গ্রামে কাজে যেতেন তিনি। যতটা না পেশায়, তার থেকে বেশি গল্প বলার নেশায়। বর্ষার নদীতে শুশুকের কাণ্ডকারখানা ছিল কাইমুদ্দিনের গল্পের মূল বিষয়। বৃষ্টিভেজা রাতে কুপির আলোর চারপাশে গোল হয়ে বসে থাকা ছেলেবুড়োরা হাঁ করে শুনতেন কাইমুদ্দিনের সেই জলের কথা।

আর নদীর গল্প? সেও আছে। বর্ষায় প্রাণ ফিরে পাওয়া তিরতিরে পদ্মার দিকে আঙুল তুলে মেয়েকে নদীর কথা শোনান হোগলবেড়িয়ার শঙ্কর মণ্ডল। মাথার উপরে জমাট কালো মেঘ। বৃষ্টি নামবে যে কোনও সময়। সে দিকে খেয়াল নেই শঙ্করবাবুর। মেয়েকে তিনি বলে চলেন, ‘‘আমাদের ছেলেবেলার নদী আর এখনকার নদীর মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক রে। তখন যেমনি ছিল তার স্রোত, তেমনি তার গর্জন। ওই যে দেখছিস, জলটা যেখানে পাক খাচ্ছে, সেখানেই ছিল বাড়ির উঠোন, তুলসিতলা। এক রাতের ভাঙনে সব শেষ।’’ জমি-বাড়ি হারিয়ে ফের পদ্মাপাড়েই নতুন করে ঘর তৈরি করেছেন শঙ্করবাবু। তাই নদী জেগে উঠলে আনন্দের পাশাপাশি ভয়ও আছে। রানিতলার বিস্তীর্ণ এলাকার গ্রাম, পঞ্চায়েত এলাকা পদ্মাগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে কয়েক দশক আগে। জেগে উঠেছে নির্মলচর, চর পিরোজপুর, চর নাড়ুখাকির মতো চর। সেখানেও বসতি গড়ে উঠেছে। পদ্মা জাগলে সিঁটিয়ে থাকে সেই সর্বহারা চর—আবার কোনও বিপদ হবে না তো? ভাল-মন্দ মিশিয়ে এই তো ক’টা দিন। শীতের শুরু থেকেই ফের শুকোতে থাকে নদী। অশ্রুদাগ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে নদীপারের জনপদও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rainy Season Memories বরষা
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE