Advertisement
E-Paper

ভক্তের অভাব, যন্ত্রে বাজছে কাঁসর-ঘণ্টা

ভরসন্ধ্যায় নবদ্বীপের গানতলা সংলগ্ন এক মন্দিরের পাশ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন প্রবীণ ভাগবত পাঠক গোরাচাঁদ ভট্টাচার্য। মন্দিরে মন্দিরে তখন চলছে সন্ধ্যারতি। ওই এলাকায় বলদেব জিউ মন্দির, মদনমোহন মন্দির, গোবিন্দবাড়ি, বড় আখড়ার মতো বেশ কয়েকটি প্রাচীন মঠমন্দির আছে।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৭ ০১:২৭
• নয়া-বাদ্যি: বুড়োশিবের মন্দিরে। নিজস্ব চিত্র

• নয়া-বাদ্যি: বুড়োশিবের মন্দিরে। নিজস্ব চিত্র

ভরসন্ধ্যায় নবদ্বীপের গানতলা সংলগ্ন এক মন্দিরের পাশ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন প্রবীণ ভাগবত পাঠক গোরাচাঁদ ভট্টাচার্য। মন্দিরে মন্দিরে তখন চলছে সন্ধ্যারতি। ওই এলাকায় বলদেব জিউ মন্দির, মদনমোহন মন্দির, গোবিন্দবাড়ি, বড় আখড়ার মতো বেশ কয়েকটি প্রাচীন মঠমন্দির আছে।

সর্বত্রই শাঁখ, ঘণ্টা, কাঁসর, খঞ্জনি খোলের চেনা শব্দে মুখরিত সন্ধ্যার নবদ্বীপ। কিন্তু গোরাচাঁদবাবু খেয়াল করলেন, সব ছাপিয়ে ওই মন্দির থেকে ভেসে আসছে অন্যরকম শব্দ। একটু চাপা গম্ভীর আওয়াজের বড় ঢাকের মতো বাদ্যের সঙ্গে সমান ভাবে বেজে চলেছে অনেকগুলি ঘণ্টা, ঘড়ি। শ্রীখোলের তীক্ষ্ণতা এবং মাধুর্য নেই সে আওয়াজে। মনে হচ্ছে, একসঙ্গে অনেকে সন্ধ্যারতির সঙ্গত করছেন। কিন্তু আওয়াজটা যেন কেমন!

প্রবীণ ভাগবত পাঠক কৌতূহল চেপে রাখতে পারলেন না। সটান ঢুকে পড়লেন গোরাচাঁদের আখড়ায়। সেখানে গিয়ে দেখেন, প্রাচীন সেই মন্দিরে সন্ধ্যারতি করছেন নিঃসঙ্গ পূজারী। পাশে বাজছে একটি মোটরচালিত অভিনব যন্ত্র। অনেকটা ধামসার মতো দেখতে একটি ড্রাম যন্ত্রের সাহায্যে বেজে চলেছে। সেই সঙ্গে বাজছে প্রায় খান ছয়েক ঘড়ি এবং ঘণ্টা। সব মিলিয়ে সে এক হইহই ব্যাপার। দূর থেকে শুনলে মনে হবে, আরতিতে কত লোকজনই না যোগ দিয়েছেন।

কিন্তু মন্দিরের বাদ্যি কেন যন্ত্র দিয়ে বাজাতে হচ্ছে? আরতির সময় কাঁসর ঘণ্টা বাজানোকে পুণ্য কাজ বলেই মনে করেন ভক্তেরা। যন্ত্র কি ভক্তদের সেই পুণ্যলাভ থেকে বঞ্চিত করছে না?

প্রায় সব মঠ-মন্দির কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, ভক্ত নেই বলেই তো যন্ত্রের আগমন। আগের মতো এখন আর নিত্যদিনের আরতিতে তেমন লোকজন আসেন না। সকলের হাতে এখন সময় কম। প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন গোরাচাঁদের আখড়ার শ্যামশ্রী দেবী বলেন, “আজ থেকে বছর পনেরো আগেও আরতির সময় কত লোকজন থাকত মন্দিরে। এখন তাঁরা কোথায়? অতএব যন্ত্রই ভরসা।”

নবদ্বীপ বুড়োশিব মন্দিরের পরিচালন সমিতির কোষাধ্যক্ষ তপন মুখোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা আরও তিক্ত। তিনি বলেন, “আরতির সময় কাঁসর-ঘণ্টা বাজানোর লোকের অভাবে সন্ধ্যারতি হতে হতে রাত নটা-সাড়ে নটা বেজে যেত। পূজারীও হা পিত্যেশ করে বসে থাকতেন, কখন কাঁসর
ঘণ্টা বাজানোর লোক আসবে। এখন আর সমস্যা নেই। যন্ত্রের সৌজন্যে সময় মেনেই আরতি হচ্ছে।”

নবদ্বীপ গৌড়ীর বৈষ্ণব সমাজের সহ-সম্পাদক কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামীর মতে, যে কোনও বৈষ্ণব মন্দিরে হিসেব মতো পাঁচ বার আরতি করতে হয়। মঙ্গলারতি, শৃঙ্গারতি, ভোগারতি, সন্ধ্যারতি এবং শয়নারতি। প্রতিবারই কাঁসর ঘণ্টা জাতীয় নানা বাদ্য সহযোগে আরতি করতে হয়। তাঁর কথায়, “একটা সময় ভক্তেরা অপেক্ষা করতেন আরতির সময় কখন তিনি একবার ঘণ্টা, কাঁসর বা মন্দিরা বাজানোর সুযোগ পাবেন। কিন্তু এখন মানুষ এত ব্যস্ত যে, উৎসবের দিন ছাড়া কারও সে ভাবে দেখাই মেলে না।”

বছর দু’য়েক আগে মোটরচালিত এমন যন্ত্র নবদ্বীপে প্রথম আসে গানতলার গোরাচাঁদের আখড়ায়। মন্দিরের সেবায়েত শ্যামশ্রী চৌধুরী জানান, তিরুপতি মন্দিরে বেড়াতে গিয়ে প্রথম ওই যন্ত্র তাঁর নজরে পড়ে। তারপর বর্ধমান থেকে ওই যন্ত্র তৈরি করানো হয়। তিনি জানান, সে সময়ে বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দির এবং নবদ্বীপের গোরাচাঁদের আখড়াতেই ছিল ওই যন্ত্র। তারপর একে একে পোড়ামাতলার শ্যামসুন্দর জিউ মন্দির থেকে চারিচারা পাড়ার শিবমন্দির, বামাকালি, বুড়োশিব মন্দিরের মতো বিভিন্ন মন্দিরে দেখা যাচ্ছে ওই যন্ত্র।

ওই বাদ্য-যন্ত্রের দাম ষোল থেকে কুড়ি হাজারের মধ্যে। কলকাতা লালবাজারের বাদ্যযন্ত্রের দোকানে নানা আকৃতি ও দামের ওই যন্ত্র মিলছে। চাহিদা বাড়ছে দেখে এখন নবদ্বীপের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসায়ীরাও এনে দিচ্ছেন ওই যন্ত্র। ওই যন্ত্রের নির্দিষ্ট কোনও নাম নেই। তবে নবদ্বীপে অনেকেই হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘নিতাই-গৌরের ব্যান্ড।’’

সেই ব্যান্ডের দাপটে বৈষ্ণব মন্দিরে মহাপ্রভুর আরতির সময়ে গাইতে থাকা মহাজন পদও কি একসময় যন্ত্রেই বাজবে? মঠ-মন্দির কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, সে প্রশ্নের উত্তর দেবে সময়।

Worship
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy