Advertisement
০৪ মে ২০২৪

নিজের বাড়িতেই খুন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা

হাট করে খোলা আলমারি। লন্ডভন্ড ঘর। খাটের উপর পড়ে রয়েছে বৃদ্ধার নিঃসাড় দেহ। নাক-মুখ দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত।

প্রতিবেশিদের সঙ্গে কথা বলছে পুলিশ। — নিজস্ব চিত্র

প্রতিবেশিদের সঙ্গে কথা বলছে পুলিশ। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:১৪
Share: Save:

হাট করে খোলা আলমারি। লন্ডভন্ড ঘর। খাটের উপর পড়ে রয়েছে বৃদ্ধার নিঃসাড় দেহ। নাক-মুখ দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত।

সকাল বেলা ঘুমই ভাঙে প্রতিবেশিনীর নামসংকীর্তনে। বুধবার সকালে তার অন্যথা হওয়ায় অনেকেই বলাবলি করেছিল, ‘একা মানুষ, কী জানি জ্যাঠাইমার শরীরটা খারাপ হল নাকি!’ কিন্তু পরিচারিকার হাঁকডাকেও সাড়া না দেওয়ায় ছুটে আসেন পড়শিরা। আর দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখা মিলল এই দৃশ্যের।

নবদ্বীপ পুরসভার ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের নন্দীপাড়ার ঘটনা। নমিতা সাহা(৬৫) নামে ওই বৃদ্ধার এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে গোটা শহরে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, কার্যত তাঁর গানেই রোজ ঘুম ভাঙত নন্দীপাড়ার। কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে কীর্তন গাইতেন আর হাতের কাজ সারতেন। বছরের পর বছর এই রুটিনে কোনও ছেদ পড়েনি। কিন্তু বুধবার সকালে নমিতাদেবীর বাড়ি থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাননি পড়শিরা। সাতটা নাগাদ পরিচারিকা এসে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে প্রতিবেশিদের জানান। তাঁরাও কিছু ক্ষণ চেষ্টা করেন। এর পর তুলসি সাহা নামে নমিতাদেবীর এক প্রতিবেশি ফোন করেন নমিতা দেবীর দাদা অমলেন্দু সাহাকে। ফোন পেয়ে গঙ্গার অপর পাড়ে স্বরূপগঞ্জ গাদিগাছার বাসিন্দা অমলেন্দুবাবু ছুটে আসেন বোনের বাড়িতে।

খবর যায় নবদ্বীপ থানাতেও। পুলিশ বাড়িতে ঢুকে দেখে দোতলার শোওয়ার ঘরে খাটের উপর নমিতাদেবীর নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। নাক-মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। মৃতদেহের গলায় কালশিটে দাগ। পাশে পড়ে একটা কাপড়ের পাড়ের টুকরো, বালিশ। ঘরের আলমারি খোলা। জিনিসপত্র লন্ডভন্ড। এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে আসেন নদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) তন্ময় সরকার ও ডিএসপি (ডি অ্যান্ড টি) মহম্মদ আজিম।

নমিতাদেবীর পারবারিক সুত্রে জানা গিয়েছে, বৃদ্ধার স্বামী অমূল্য সাহা ছিলেন স্থানীয় ধাম বিদ্যাপীঠের প্রধানশিক্ষক। পাঁচ বছর আগে তিনি মারা যান। তার পর থেকে নবদ্বীপের নন্দীপাড়ায় প্রায় চার কাঠা জায়গার উপর দোতলা ওই বাড়িতে একাই থাকতেন নিঃসন্তান নমিতাদেবী। প্রতিবেশিরা জানান, বাড়ি থেকে কমই বেরোতেন তিনি। নমিতাদেবীর থেকে দশ বছরের বড় দাদা অমলেন্দুবাবু বলেন, “প্রতি সপ্তাহে আমরা কেউ না কেউ এসে ফ্রিজ বোঝাই করে বাজারহাট করে দিয়ে যেতাম।” দেখাশুনা করতেন ননদ অপর্ণা সাহাও।

বুধবার দুপুরে নবদ্বীপ থানায় একটি খুনের অভিযোগ দায়ের করে অমলেন্দুবাবু বলেন, “রীতিমতো পরিকল্পনা করে এই কাজ করা হয়েছে। এত বড় বাড়িতে বোন একাই থাকত। আমাদের সন্দেহ দুষ্কৃতীরা সব খবরই রাখত। অপকর্ম করার সময় বোন তাঁদের চিনে ফেলায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে, বালিশ চাপা দিয়ে খুন করা হয়েছে।” তবে কত কী খোয়া গিয়েছে, তা অবশ্য স্পষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি।

এ ব্যাপারে পুলিশ এখনই মুখ খুলতে চায়নি। নদিয়ার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া শুধু বলেন “একটি খুনের মামলা রুজু হয়েছে। পুলিশ সব দিক খতিয়ে দেখছে। মৃতদেহের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে এলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ-সহ অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে।”

কিন্তু এ সবের মাঝে একটা প্রশ্ন উঠে আসছে বারবার। নমিতাদেবীর মতো নিঃসঙ্গ প্রবীণদের জন্য নবদ্বীপ শহরটা কি আদৌ নিরাপদ? নিঃসন্তান কিংবা ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকেন, বাড়িতে একাই থাকেন, এমন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সংখ্যা তো নেহাত কম নয় নবদ্বীপে। এ দিনের ঘটনায় তাঁরা আতঙ্কিত। রানীর চড়ার বাসিন্দা বাহাত্তর বছরের গীতা আচার্যের দুই ছেলেই বাইরে থাকে। বললেন, “সারাদিন একা থাকি। বিছানায় পড়ে গেলে ওষুধ এনে দেওয়ার জন্য ভরসা পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা।” আবার প্রাচীন মায়াপুরের গৌরী সরকারের এক মাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, “ফোনে নিয়মিত মেয়ের সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু বাড়িতে তো একাই। একে বুড়ো মানুষ, তায় একা। বিপদের কি শেষ আছে।”

এ সব বিপদ-আপদের কথা মাথায় রেখে আর প্রবীণদের ভরসা দিতে ‘প্রণাম’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে কলকাতা পুলিশ। বিষয়টা এমন— ২৪ ঘণ্টা যে কোনও প্রয়োজনে ফোন করে সাহায্য চাওয়া যাবে নির্দিষ্ট হেল্প লাইন নম্বরে।

কলকাতা পুলিশের এই ‘প্রণাম’-এর মতোই নদিয়া জেলার পুলিশ কি নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাহায্যের জন্য কিছু করার কথা ভাবছে? উত্তরে নদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তন্ময় সরকার বলেন, “এমন ঘটনার পরে তো ভাবতেই হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Old woman Killing
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE