চণ্ডীমণ্ডপের সামনে নিমতলায় জনা পঁচিশেক মানুষের জটলা। সেখানে হাতজোড় করে কনেপক্ষের কর্তা বলছেন, ‘‘মেয়ের বিয়ের দিন স্থির হয়েছে। আপনারা অনুমতি দিন।’’ ‘দশ’, ‘সমাজ’-এর লোকজন এ বার বিয়ে সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে অনুমতি দেন। বরকর্তা, অথবা কনেকর্তা আবার করজোড়ে বলেন, ‘‘আমার অর্থিক অবস্থা ভাল নয়। তাই সবাইকে হাঁড়ি বারণ বলতে পারছি না। ক্ষমা করবেন। তবে পুরুষবর্গের নেমতন্ন থাকবে।’’ কয়েক জনের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁদের মনোভাব বোঝার পর সমাজপতি আদেশ দিতেন, ‘‘ঠিক আছে। তাই হবে! রেডিয়ো, সাইকেল, সোনার চেন ছাড়া বাবাজীবনকে আর কী দিচ্ছ হে ঘোষাল?’’ নবগ্রাম থানার পাঁচগ্রামের বৃদ্ধ আক্কাশ আলি বলেন, ‘‘আগে এটা ছিল প্রায় সব গ্রামের, সব সম্প্রদায়ের রীতি।’’
কয়েক বছর আগেও বিভিন্ন গ্রামে ৮-১০টি ‘সমাজ’, বা ‘দশ’ ছিল। ২৫-৫০টি পরিবার নিয়ে গড়া সমাজ বা দশ আজও পুরোপুরি অবলুপ্ত নয়। তবে দশ-সমাজের বাঁধন আগের থেকে এখন অনেক আলগা। চণ্ডীমন্ডপে গিয়ে সন্তানের বিয়ের জন্য এখন আর সমাজের অনুমতি নিতে হয় না। আগে গ্রাম-সমাজকে এড়িয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করা অসম্ভব ছিল। সমাজপতির সম্মতি পাওয়ার পরে আত্মীয়-কুটুম্ব ও পড়শিদের নিমন্ত্রণ করার পালা ছিল। সাইকেলে, বা ঘোড়ায় চেপে পান, সুপারি ও লবঙ্গ নিয়ে বিয়ে বাড়ির পুরুষেরা বেরিয়ে পড়তেন নিমন্ত্রণ করতে। পান-সুপারি দেওয়ার পরে বলা হত, ‘‘হাঁড়ি মানা থাকল।’’ কখনও তাঁরা বলতেন, ‘‘একটা।’’
হাঁড়ি মানা, অর্থাৎ হাঁড়ি বারণ মানে বিয়ের দিন আমন্ত্রিতের বাডিতে উনুন জ্বলবে না। বিয়ের দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওই বাড়ির সবার নিমন্ত্রণ বিয়ে বাড়িতে।
অন্য গ্রামের আত্মীয় পরিজনেদের এক বার পান-সুপারি দিলেই ঝামেলা চুকে যেত। পড়শির ক্ষেত্রে নিমন্ত্রণের হ্যাপা ছিল অনেক বেশি। মুর্শিদাবাদের লোকসংস্কৃতির গবেষক দীপক বিশ্বাস বলেন, ‘‘প্রতিবেশী বা সমাজের লোকজনদের পান-সুপারি দিয়ে নিমন্ত্রণ করার পরেও অনুষ্ঠানের দিন সকালে আরও এক বার মৌখিক নিমন্ত্রণ করতে হত। রান্না হয়ে গেলে আরও এক বার বাড়ি গিয়ে বলা হত, ‘রান্না হয়ে গিয়েছে। চলে আসুন।’ নইলে আমন্ত্রিতদের মান মর্যাদা ক্ষুন্ন হত।’’
বিয়ের নিমন্ত্রণ করার সময় গ্রাম সমাজে উঠে আসত ‘একঘরে’, অর্থাৎ ‘বয়কট’ প্রসঙ্গ। ভরতপুর থানার টেঁয়া বৈদ্যপুরের কালোসোনা বৈরাগ্য বলেন, ‘‘একঘরে করে রাখা পরিবারকে নিমন্ত্রণ করা যেত না। নয়তো বিয়ের কয়েক দিন আগে সালিশি ‘বিচার সভা’ বসিয়ে একঘরে তকমা তুলে নেওয়া হত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy