Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
আক্রান্ত মানসিক ভারসাম্যহীন

পাচার সন্দেহে মারধরে মৃত্যু

খুশির অভিযোগ, ভোরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখে, তার পাশে বিছানায় এক মহিলা শুয়ে। ভয়ে সে চিৎকার করে উঠলে মহিলা তার গলা টিপে ধরেন। চিৎকার শুনে ঘর থেকে তার মা শ্যামলী বেরিয়ে আসেন। মহিলা তাঁকে ঘুষি মেরে পালানোর চেষ্টা করেন।

বলি: তখন চলছে মারধর। সেকেন্দ্রায়। নিজস্ব চিত্র

বলি: তখন চলছে মারধর। সেকেন্দ্রায়। নিজস্ব চিত্র

বিমান হাজরা
জঙ্গিপুর শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৭ ০২:১২
Share: Save:

নারী পাচারকারী সন্দেহে এক মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলাকে পিটিয়ে মারল গ্রামবাসীরা। ইদে তিনি বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন।

মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া সেকেন্দ্রা গ্রামের ঘটনা। মহিলার পরিবারের লোকজন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

পুলিশ জানায়, মৃতার নাম উতেরা বিবি (৪০)। মঙ্গলবার ভোরে সেকেন্দ্রা গ্রামে দিলীপ ঘোষের বাড়ির বারান্দায় ঠাকুমার সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল একাদশ শ্রেণির ছাত্রী খুশি ঘোষ। খুশির বাবা বাড়িতে ছিলেন না।

খুশির অভিযোগ, ভোরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখে, তার পাশে বিছানায় এক মহিলা শুয়ে। ভয়ে সে চিৎকার করে উঠলে মহিলা তার গলা টিপে ধরেন। চিৎকার শুনে ঘর থেকে তার মা শ্যামলী বেরিয়ে আসেন। মহিলা তাঁকে ঘুষি মেরে পালানোর চেষ্টা করেন।

পড়শিরা চলে আসেন। গ্রামে রটে যায়, মেয়ে পাচারকারী ধরা পড়েছে। গত ২১ জুন রাতে ওই গ্রামেরই এক কিশোরী উধাও হয়ে গিয়েছে। তারও মাস দেড়েক আগে এক কিশোরীকে ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়। তার চিৎকারে পড়শিরা ছুটে এলে পালিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা ।

পদ্মাপাড়ের গ্রাম সেকেন্দ্রায় এর পর থেকেই আতঙ্ক গেঁড়ে বসেছে। সম্ভবত সেই কারণেই উতেরা বিবিকে একটি পরিত্যক্ত ট্রাক্টরের সঙ্গে বেঁধে মারধর করা শুরু হয়। গ্রামেই রয়েছে পুলিশ ক্যাম্প। মাইল দুই দূরেই জঙ্গিপুর পুলিশ ফাঁড়ি। খবর পেয়ে পুলিশ গেলেও কয়েক হাজার লোকের জনরোষ থেকে উদ্ধার করতে পারেনি মহিলাকে। ঘণ্টা তিনেক পরে বড় বাহিনী গিয়ে যখন তাঁকে উদ্ধার করে, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়।

স্থানীয় সূত্রের খবর, উতেরা বিবির বাপের বাড়ি সেকেন্দ্রা থেকে মাইল দুই দূরের পানানগরে। ইদের জন্য শ্বশুরবাড়ি কৃষ্ণশাইল তিনি বেড়াতে এসেছিলেন। আগের রাতে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় বাড়ির লোকজন তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁর মা, ষাটোর্ধ্ব বাদেনুর বিবি জানান, তাঁর ছয় মেয়ের মধ্যে উতেরাই বড়। চার ছেলেমেয়েও রয়েছে তাঁর। ২০০৭ সাল থেকে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন। এ দিনই বহরমপুরে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাঁকে। কিন্তু সোমবার রাত ১টা নাগাদ তিনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সকালে তাঁদের এক আত্মীয় সেকেন্দ্রা দিয়ে লালখান্দিয়ার গ্রামে যাওয়ার সময়ে দেখেন, তাঁকে ঘিরে ধরে গণধোলাই দেওয়া হচ্ছে। তিনিই বাড়িতে খবর দেন। বাড়ির লোকজন জানান পুলিশকে। কিন্তু এর পরেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি।

উতেরার মৃত্যুর খবর পেয়ে বিকেলে বিভিন্ন গ্রাম থেকে তাঁদের আত্মীয়-পরিজনেরা জঙ্গিপুরে পুলিশ মর্গে চলে আসেন। আসেন তাঁর স্বামী ও ছেলেমেয়েরাও। গণপিটুনিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে পুলিশ লিখিত অভিয়োগ না নেওয়া পর্যন্ত মৃতদেহ নেবেন না বলে তাঁরা জানিয়ে দেন। পুলিশ সন্ধ্যায় অভি‌যোগ নিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

রঘুনাথগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক আখরুজ্জামান এই মৃত্যুর জন্য পুলিশের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। তাঁর আক্ষেপ, “এক মহিলা উন্মত্ত জনতার হাতে মার খাচ্ছে জেনেও পুলিশ তিন ঘণ্টা পরে তাঁকে উদ্ধার করেছে। উনি অপহরণকারী হোন বা মানসিক ভারসাম্যহীন, তাঁকে পিটিয়ে মারার অধিকার কারও নেই। পুলিশ ঠিক সময়ে সক্রিয় হলে ওঁকে এ ভাবে মরতে হত না।’’

রঘুনাথগঞ্জ থানার আইসি সৈকত রায় অবশ্য পুলিশের গাফিলতি মানতে চাননি। রাতে তিনি বলেন, “যারা আইন হাতে তুলে নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। ”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE