নবাব-বাদশার দেশ বলে কথা! ফলে মুর্শিদাবাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মানচিত্রের মতো সাংস্কৃতিক মানচিত্রেও রয়েছে হরেক মজা। যেমন, সারা দেশ ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীন হলেও নবাবের দেশ মুর্শিদাবাদ ‘স্বাধীন’ হয় তিন দিন পরে, অর্থাৎ ১৮ অগস্ট। তবে কি ওই তিন দিন এ জেলা পরাধীন ছিল? না, পরাধীন ছিল না। ছিল স্বাধীন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। অবশেষে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত প্রচেষ্টায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিন দিন পরে মুর্শিদাবাদ জেলা স্বাধীন ভারতের ভুক্ত হয়। ফন্দিবাজ ব্রিটিশ শাসকদের মন গলিয়ে পাকিস্তানের মানচিত্র থেকে মুর্শিদাবাদ জেলাকে ভারতের মানচিত্রে নিয়ে যাওয়ার কঠিন কর্মকাণ্ডের সর্বজনবিদিত কাণ্ডারী ছিলেন নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জা। এ হেন জেলায় নববর্ষ উদযাপনে বৈচিত্র থাকাটাই স্বাভাবিক। রয়েছেও তাই।
কেমন?
নবাবের দেশ মুর্শিদাবাদে পয়লা বৈশাখের মাস খানেক আগেই ২১ মার্চ একপ্রস্ত নববর্ষ উদযাপন করা হয়। ভাষা ভেদে অবশ্য প্রথম কিস্তির নববর্ষের নাম ‘নওরোজ’। সেই নবাবি আমল থেকে এখানে নওরোজ উদযাপনের রেওয়াজ চলে আসছে। আগের মতো জাঁক জমক না থাকলেও নওরোজ উযাপনের সেই ট্রাডিশান কিন্তু আজও ভাগীরথী পাড়ের ঐতিহাসিক শহর লালবাগের মাটিতে বর্তমান। একটি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন, “শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিমদের বিশ্বাস অনুসারে ২১ মার্চ নওরোজ। অর্থাৎ নতুন দিন। আবীর মেখে, বাড়িতে তৈরি নানখাতাই নামের মিষ্টান্ন সহযোগে নবাবি আমলে নওরোজ উদযাপনের জৌলুস ছিল গর্ব করার মতো!” কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির ‘রানিমা’ সুপ্রিয়া রায়ও পুরনো স্মৃতি হাতড়ে পয়লা বৈশাখের হরেক রকম মিষ্টান্নের ব্যাখ্যান শোনান।
দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কাঠের বিশাল উনুনে বসানো থাকত দুধ ভর্তি বিশালাকৃতির বেশ কয়েকটি কড়াই। আগুনের তাপে পুরু হয়ে জমত সর। ওই সর আর মোয়া দিয়ে ব্যস্ত ময়রার দল তৈরি করতেন সরপুরিয়া, সরভাজা, রাবড়ি, চমচম, চন্দ্রপুলি, মালপোয়া, আরও কত রকমের মিষ্টান্ন। এ কথা বলার পর রানিমা বলেন, “বাবার (প্রয়াত শ্বশুরমশায়) কাছে শুনেছি ওই মিষ্টান্ন বড় সরাতে গোলাপজল ও আতর সহযোগে বিয়ের তত্ত্বের মতো করে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে সৈয়দাবাদের রাজবাড়িতে, লালবাগের নবাব পরিবারে, আজিমগঞ্জ, জিয়াগঞ্জ, লালবাগ, লালগোলার রাজবাড়ি-সহ অনেক জমিদার বাড়িতে পাঠানো হত। নববর্ষের পূন্যলগ্নে রাজবাড়িতে পাতপেড়ে মিষ্টান্ন-সহ ভুরিভোজ করিয়ে গরিব প্রজাদের নতুন
কাপড় দান করার রেওয়াজও ছিল। শতবর্ষ আগের সেই দিন আর নেই।”
সেই দিন গত হলেও সুপ্রিয়াদেবী ও তাঁর স্বামী প্রশান্তকুমার রায়ের উদ্যোগে কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির মিষ্টান্ন এখন গোটা রাজ্য জুড়ে ‘রাজত্ব’ করছে। রায় দম্পতির ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এর প্যাকেট বন্দি মিষ্টান্নের স্বাভাবিক চাহিদা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে অস্বাভাবিক রকমে বেড়ে যায়। সুপ্রিয়াদেবী বলেন, “জিরো ফিগার তত্ত্বের সুবাদে এখন না-খাওয়াটাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু বাঙালির মিষ্টি প্রিয়তা এতটাই, যে স্রেফ মিষ্টান্নের জন্য নতুন একটা শাখা খুলতে হয়েছে।” নববর্ষের হালখাতা করতে দোকানদাররা নিয়মিত খদ্দেরকে নিমন্ত্রণ করেন। নিমন্ত্রিত খদ্দেরদের জন্য মিষ্টির প্যাকেট সরবরাহ করতে আগাম মিষ্টির দোকানে বরাত দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:রানির মান ভাঙাতে বারোদোলের মেলা
সুপ্রিয়াদেবী বলেন, “কালাকাঁদ, রসভরা-তালশাস, ক্ষীরের বরফি, মালাই বরফি, ল্যাংচা, বাদশাভোগ, ক্ষীর কদম, মুগডালের লাড্ডু, গোলাপ-সন্দেশ ভর্তি প্যাকেট নববর্ষের ভোরে কলকাতা, বহরমপুর-সহ বিভিন্ন শহরের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দিতে হয়।” সব বরাত অবশ্য নিতে পারেন না বহরমপুরের ছানাবড়ার জন্য বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের মালিক বিজয় গোপাল সাহা ওরফে গোরা। তিনি বলেন, “বছরের অন্য দিনের থেকে নববর্ষের মিষ্টান্নের চাহিদা এতটাই বেশি যে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ওই দিনের জন্য ছানা, মোয়া-সহ মিষ্টান্ন
তৈরির উপকরণ অন্তত ১০ গুণ বাড়িয়ে দিতে হয়। চাহিদা অপরিসীম কিন্তু ছানা ও মোয়ার যোগান তো সীমিত। ফলে অনেক বরাত ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হই।”
পয়লা বৈশাখের চাহিদা মতো মিষ্টান্নের বাড়তি যোগান দেওয়ার জন্য বাড়তি সময় ও ময়রা পাওয়া তো অসম্ভব। ফলে মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের কৌশলী হতে হয়। বহরমপুরের অভিজাত এক মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তা ভজন ঘোষ বলেন, “নববর্ষে নাড়ুর চাহিদা খুব বেশি। এ কারণে কয়েক দিন আগে থেকে নাড়ুর জন্য বোদে ঘিয়ে ভেজে রেখে দেওয়া হয়। নববর্ষের আগের দিন চিনির সেরায় পাক দিয়ে নাড়ু তৈরি করা হয়। একই রকম ভাবে ছানাবড়া, রাজভোগের মতো কড়াপাকের মিষ্টান্ন দু’ এক দিন আগেই তৈরি করে মজুত রাখা হয়। কড়াপাকের মিষ্টান্ন বেশ কয়েক দিন রেখে দিলেও নষ্ট হয় না। ফলে নববর্ষের চাহিদা মেটাতে ওই কৌশল নিতে হয়।” তবুও সব খরিদ্দারের মন জোগানো যায় না। এ কথা জানিয়ে আর এক মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক সাধন ঘোষ বলেন, “আসলে নববর্ষে মুখ মিষ্টি ছাড়া বাঙালির যে চলে না!” ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষ বাঙালির জাতীয় উৎসব যে ।
সময়ের বিবর্তনের ফলে পয়লা বৈশাখের হাল খাতায় পরিবর্তন এসেছে। আগে দোকানে হালখাতা করতে যাওয়া লোকজনকে গদিতে বসিয়ে সরবত খাইয়ে লাড্ডু, বা বাতাসার মতো মিষ্টান্নের প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত। এখন চেয়ারে বসিয়ে বহুজাতিক সংস্থার শীতল পানীয় খেতে দেওয়া হয়। এখন পয়লা বৈশাখ নববস্ত্র পরে নববর্ষ উদযাপনের জন্য চৈত্র সেল-এর আমদানি হয়েছে। নববর্ষ উদযাপনের জন্য এখন বিভিন্ন সংস্থা নানা আয়োজন করে।
যেমন বহরমপুরের ‘ঋত্বিক’ নাট্যগোষ্ঠী বাংলা বছরের শেষ রাত থেকে নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয় পর্যন্ত টানা নাটক মঞ্চস্থ করে, সঙ্গীত পরিবেশন করে। বর্ষবরণের এই আয়োজন টানা ৯ বছর ধরে চলে আসছে। রয়েছে পয়লা বৈশাখ ভোরে লালবাগের ‘মুর্শিদাবাদ শহর বইমেলা কমিটি’ ও ‘সুরছন্দ’র যৌথ উদ্যোগের শহর পরিক্রমা। সঙ্গে গান, বাজনা, নাচ, আবৃত্তি। জিয়াগঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমীর ঘোষ বলেন, ‘‘নববর্ষ বরণে আগের থেকে আয়োজন ও আড়ম্বর বেড়েছে অনেক। কমেছে আন্তরিকতা!’’ কলেজ শিক্ষক বর্তমান প্রজন্মের সমিত মণ্ডলের মতে, ‘‘অতীতের মায়ায় আচ্ছন্ন থাকা বরাবরের একটা অভ্যাস। সেই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে নববর্ষের আলোয় অনেক ভাল কিছু উদ্ভাসিত হয়ে ধরা দেয় বর্তমান সময়েও।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy