Advertisement
E-Paper

প্রশ্ন করলেই জুটত ধমক, বলছে দুই ছাত্রী

ছুটি হয়ে যায় দুপুর-দুপুর। “তার পরে কী হয় মাদ্রাসায়”, জানতে চাইলেই ধমক। মাদ্রাসা-বাড়িটাতে চোদ্দোটা ঘর থাকলেও, পড়াশোনা হতো পাঁচ-ছ’টায়। “বাকিগুলোয় কী হয়”, ধমক জুটেছে সেটা জানতে চেয়ে। মাঝেমধ্যে ছাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট মাদ্রাসায় দেখা যেত বাইরের কিছু পুরুষ-মুখ। “ওরা কারা?” এরও জবাব, ধমক। সঙ্গে হুঁশিয়ারি, “যা পড়তে এসেছিস, তা-ই পড়। অন্য দিকে মাথা গলাস না।”

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৩৮

ছুটি হয়ে যায় দুপুর-দুপুর। “তার পরে কী হয় মাদ্রাসায়”, জানতে চাইলেই ধমক।

মাদ্রাসা-বাড়িটাতে চোদ্দোটা ঘর থাকলেও, পড়াশোনা হতো পাঁচ-ছ’টায়। “বাকিগুলোয় কী হয়”, ধমক জুটেছে সেটা জানতে চেয়ে। মাঝেমধ্যে ছাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট মাদ্রাসায় দেখা যেত বাইরের কিছু পুরুষ-মুখ। “ওরা কারা?” এরও জবাব, ধমক। সঙ্গে হুঁশিয়ারি, “যা পড়তে এসেছিস, তা-ই পড়। অন্য দিকে মাথা গলাস না।”

এমন অভিজ্ঞতা যাদের, তারা ছাত্রী। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) নজরে থাকা লালগোলার মকিমনগরের মাদ্রাসার।

বছর তেরো আর চোদ্দোর দুই কিশোরী পড়ত ১৩০টি মেয়ের ওই অনুমোদনহীন মাদ্রাসায়। বয়সে ছোট মেয়েটি পড়েছে দু’বছর। অন্য জন মাস চারেক। এলাকাতেই থাকে। তাই দুপুর ২টোর পরে পড়াশোনা শেষে মাদ্রাসা ছেড়ে চলে আসতো। আর নানা প্রশ্ন করে যাদের কাছে ধমক খেত— তারা বড় দিদি। দিন-রাত ওই মাদ্রাসায় কাটানো আবাসিক ছাত্রী।

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে, ঈদের ছুটির নোটিস লটকে সপরিবার নিখোঁজ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় বাসিন্দা মোফাজ্জুল শেখ। আবাসিক ছাত্রীরাও নেই। আসছেন না বহিরাগত শিক্ষিকারা (আলেমা)। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে এই মাদ্রাসা এবং তার প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে গোয়েন্দাদের সন্দেহের কথা সামনে আসতেই চিন্তায় পড়ে গিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা দুই ছাত্রীর পরিবার। ছুটির পরে, ১৮ অক্টোবর খোলার কথা থাকলেও মাদ্রাসার দরজা আর খুলবে কি না, তাদের সংশয় রয়েছে তা নিয়েও।

দুই ছাত্রী বুধবার জানায়, বাইরের জেলা থেকে আসা অনেক মেয়েই ওই মাদ্রাসায় পড়ত। মাদ্রাসাটিতে নার্সারি (যে বয়সেরই ছাত্রী হোক, মাদ্রাসায় শিক্ষা না থাকলে তাকে নার্সারিতেই ভর্তি হতে হতো। সাত বছরের নীচে নার্সারিতে ভর্তি নেওয়া হতো না) থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ছিল। সাত জন শিক্ষিকা ছিলেন। দশ বছরের উপরের বহিরাগত মেয়েদের বোরখা পরতে হতো। ছোটরা আসত ওড়নায় মুখ ঢেকে। পাঠ্যক্রমে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে বর্ণ পরিচয় ছিল, যাতে— ‘ছ-এ ছড়া শেখো আল জেহাদের’, ‘জ-এ জেহাদি’র পাঠ নিয়েছে তারা। তদন্তে গোয়েন্দারা জেনেছেন, মঙ্গলকোটের শিমুলিয়ার মতো এই মাদ্রাসাতেও পড়ানো হতো বাংলা বই— ‘ভাল মৃত্যুর উপায়’।

মেয়ে দু’টির দাবি, মাদ্রাসাটিতে যারা আবাসিক, আর যারা বহিরাগত তাদের মধ্যে ‘কিছুটা দূরত্ব’ ছিল। আবাসিকেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলত ফিসফিসিয়ে। বাইরে থেকে আসা মেয়েরা কিছু জানতে চাইলে, হয় চুপ করে যেত। দশটা প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দিত। না হলে খেঁকিয়ে উঠত। মেয়ে দু’টির কথায়, ‘‘আবাসিক দিদিরা অনেকেই আমাদের থেকে চার-পাঁচ বছরের বড়। কিন্তু আমরা চলে যাওয়ার পরে মাদ্রাসাতে কী হয়, কেন হয়, জানতে চাইলেই রেগে যেত।” এক জনের অভিজ্ঞতা, “মাঝেমধ্যেই বাইরের কিছু লোক আসত। তারা আমাদের পড়াত না। কিন্তু দু’-এক দিন মাদ্রাসায় কাটিয়ে চলে যেত। এক বার ‘ওরা কারা’ জানতে চাওয়ায় দিদিরা খুব ধমকেছিল। তার পরে কিছু জানতে চাইতে হলে ভয় পেতাম।”

খাগড়াগড় কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত তথা বিস্ফোরণে জখম আব্দুল হাকিমকে কি তারা চিনত? মেয়ে দু’টি জবাব দেয়নি। আলিমা বিবি, রাজিয়া বিবিদেরও কি তারা মাদ্রাসায় দেখেছে? এ বারও ছাত্রীরা নিরুত্তর। তদন্তে গোয়েন্দারা জেনেছেন, যারা মাদ্রাসায় থাকত, তাদের বাইরে যাওয়ার হুকুম ছিল না। বাইরের কেউ যাতে তাদের দেখে না ফেলে, সে জন্য একতলায় দশ ফুট এবং ছাদের চারদিক প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হয়েছিল। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, এই মাদ্রাসাটিতে একেবারে শিশু কোনও আবাসিক না থাকলেও, সেখান থেকে শিশুদের শৌচকর্মের উপযুক্ত প্লাস্টিকের পাত্র মিলেছে। তাতে গোয়েন্দাদের ধারণা হয়েছে, বাচ্চাদের নিয়ে আলিমা ও রাজিয়া সেখানে আসত। তারাই মাদ্রাসার বাছাই কিছু ছাত্রীকে শেখাত জেহাদের পাঠ। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “ওই মাদ্রাসার আবাসিক ছাত্রীদের জেরা করলে আরও কিছু তথ্য উঠে আসবে।”

তবে আপাতত স্থানীয় ছাত্রীদের সূত্র ধরেই মাদ্রাসাটিকে ঘিরে এলাকাবাসীর একটা বড় অংশেরও সন্দেহ ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। এমনিতেই ২ অক্টোবর খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে রাজিয়া, আলিমা ও হাকিমের ছবি সংবাদমাধ্যমে দেখে চমকে উঠেছিলেন তাঁরা। কারণ, সাত-আট মাস আগেও হাকিমকে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রান্না করতে দেখা গিয়েছে। সেই সুবাদেই সেখানে যাতায়াত ছিল রাজিয়া-আলিমার। এখন স্থানীয় বাসিন্দা ছাত্রীদের কাছ থেকে মাদ্রাসার ভিতরের ‘গল্প’ জেনে তাঁদেরও অনেকে বলছেন, “মেয়েদের মাদ্রাসায় আড়াল-আবডাল থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে এমন কিছু নতুন মুখ আসত, যাদের সঙ্গে পড়াশোনার যোগ ছিল বলে আমাদের মনে হয়নি।” একই সুর যেন দুই ছাত্রীর বাবার গলায়। তাঁরা বলছেন, “ভেবেছিলাম, মেয়েরা ওই মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষা নিচ্ছে, ভাল ব্যাপার। এখন বুঝছি, ওই মাদ্রাসাটা বাছা উচিত হয়নি।”

এলাকায় ঘুরে জানা গিয়েছে, মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মোফাজ্জুলের পশ্চিম এশিয়া-প্রীতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কথায় কথায় সে আরবের উদাহরণ টানত। এই স্বভাব আর মাথায় সাদা পাগড়ির জন্য এলাকার অনেকে তাঁকে ‘লাদেন’ বলতেন। মোফাজ্জুলের কাকা আব্দুল মাজিদ বলেন, “পালিয়ে গিয়ে ভাইপো ভাল কাজ করেনি।”

anal abedin lalgola madrasah latest news online news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy