Advertisement
১৮ মে ২০২৪
আ মরি বর্ষা/১

জমা জলে ঘাপটি মেরে মরণ

বর্ষা মানেই ইলিশ-খিচুড়ি, কাচের জানালার ওপাশে ঝাপসা চরাচর দেখতে দেখতে রবি ঠাকুরের গান। এটা যদি বৃষ্টির এ-পিঠ হয় তবে ও-পিঠে চোরাস্রোতের মতো বইছে অন্য আশঙ্কা। জমা জলের পাশে ডুবে থাকা বাতিস্তম্ভের তারটা খোলা নেই তো? জলে ডোবা রাস্তায় টাল সামলে হাঁটাচলা যাবে তো? ভরা নদীতে নৌকা ছাড়ার পরেই ঢিপঢিপ করে বুক— ওপারে পা রাখতে পারব তো? বৃষ্টির হাত ধরে খোঁজ নিল আনন্দবাজার।সকাল থেকে ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। এমন বাদল-দিনে বাইরে যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছে ছিল না কান্দির হাসিবুর শেখের। কিন্তু বাড়িতে অতগুলো অবলা পশু খাবে কী? অগত্যা হাঁসুয়া নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন ঘাসের খোঁজে।

এ ভাবেই খোলা রয়েছে জয়েন্ট বক্স। — নিজস্ব চিত্র

এ ভাবেই খোলা রয়েছে জয়েন্ট বক্স। — নিজস্ব চিত্র

শুভাশিস সৈয়দ ও সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৬ ০১:৪৬
Share: Save:

সকাল থেকে ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। এমন বাদল-দিনে বাইরে যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছে ছিল না কান্দির হাসিবুর শেখের। কিন্তু বাড়িতে অতগুলো অবলা পশু খাবে কী? অগত্যা হাঁসুয়া নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন ঘাসের খোঁজে। সবুজ ঘাসও মিলেছিল। কিন্তু তড়িঘড়ি বাড়ি ফেরার পথেই ঘটল বিপদ। সাপ নয়, আলপথে পড়েছিল মাঠের গভীর নলকূপের বিদ্যুতের তার। সেই তার পায়ে ঠেকতেই ঘাসের বোঝা নিয়ে উল্টে পড়েন হাসিবুর (২৬)। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ।

আবার নওদার সেই যুবক তো জানতেনই না অবলা গরুটা ও ভাবে দাপাচ্ছে কেন? তাড়াতাড়ি গিয়ে দড়িটা ধরে গরুটাকে বাগে আনতে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে ওই যুবক। নিথর গরুটির গায়ে তখনও লেপ্টে বিদ্যুতের তার।

এমন ঘটনা এ বার নতুন নয়। ফি বর্ষায় এমন দু’চারটে মৃত্যু দেখে গাঁ-গঞ্জ-শহর। কোথাও ঝুলছে হাইটেনশনের তার, কোথাও ঝড়ের দাপটে তার ছিটকে পড়েছে গাছের উপরে, কোথাও আবার বেমালুম খোলা রয়েছে হাইটেনশন লাইনের ‘জয়েন্ট বক্স’। সকলেই সকলের উপরে দায় চাপাতে ব্যস্ত। কখনও আবার শোনা যায়, ‘কড়া পদক্ষেপের’ প্রতিশ্রুতি। তবে তা বর্ষায় মুড়ির মতোই দ্রুত মিইয়ে যায়। দেখতে দেখতে আরও একটা বর্ষা চলে আসে। কৃষ্ণনগর থেকে কান্দি, বহরমপুর থেকে বাদকুল্লা, জলঙ্গি থেকে জঙ্গিপুর, করিমপুর থেকে কল্যাণী কিংবা নবদ্বীপ থেকে নওদা—ছবিটা সর্বত্রই কমবেশি একই রকম!

সম্প্রতি কলকাতার ভবানীপুরে ঝুলে থাকা বিদ্যুতের তারে স্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছে বছর চোদ্দোর যশ বেঙ্গানি। তার পরিবারের অভিযোগ, গত সোমবার সন্ধ্যায় রমেশ মিত্র রোডে জমা জল ঠেলে বাড়ি ফিরছিল ওই যুবক। গাড়ি যাওয়ার ফলে জলের ঢেউয়ের ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাওার সময় ত্রিফলা স্তম্ভের গায়ে জড়ানো নীল-সাদা আলোর খোলা তারে হাত লেগে যায় তার। শখের আলোয় এমন শকের বিপদের পরে ওই মৃত্যু ঘিরে শুরু হয়েছে চাপানউতোরও।

কলকাতা তো বটেই, জেলাতেও এমন অবস্থা যে কোনও সময়ে ঘটতে পারে বলে অভিযোগ করেছেন বহরমপুর কিংবা কৃষ্ণনগরের মতো জেলা সদরের নাগরিকেরা। বহরমপুর শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি থেকে তার ঝুলে থাকা, জনবহুল এলাকায় ট্রান্সফর্মারের ঢাকনা খোলা থাকা অতি পরিচিত দৃশ্য।

মোহনের মোড়ের কাছেই রাস্তার ধার ঘেঁষে হাই-টেনশন লাইনের বিদ্যুতের ‘জয়েন্ট বক্স’ খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয় জেন ওয়াই। বিপদ ঘটতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। অথচ বিদ্যুৎ দফতর ও পুর কর্তৃপক্ষের কোনও নজরদারি নেই বলেই অভিযোগ। রবীন্দ্রসদনের উল্টো দিকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পাশেই ত্রিফলা বিদ্যুতের ‘বক্স’ খোলা থাকায় এলাকার মানুষ নিরাপত্তার কারণে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে পলিথিন দিয়ে বেঁধে রেখেছে ফিউজ বক্স যাতে বড় ধরনের কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে।

বিষয়টি শুনে বহরমপুরের উপ-পুরপ্রধান কংগ্রেসের মইনুদ্দিন চৌধুরী পুরসভার বিদ্যুৎ দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে দায় সারেন। আর পুরসভার বিদ্যুৎ দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুব্রত সাহা বলছেন, ‘‘কী করব বলুন তো? ফিউজ বক্সের লোহার ঢাকনা বার বার চুরি হয়ে যাচ্ছে যে!’’

কৃষ্ণনগর শহরে গত দু’দিনে অন্তত ৩৫টি জায়গায় গাছের ডাল ভেঙে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। মানিকপাড়ার নিরঞ্জন পাল বলছেন “ভাগ্য ভাল যে, সেই সময় রাস্তা দিয়ে কেউ যাচ্ছিল না। নাহলে কী বিপদ ঘটত বলুন তো?’’

বিপদ বলে বিপদ! বর্ষাকালে এক বজ্রপাতে রক্ষা নেই, দোসর আবার বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ার ঘটনা। বিদ্যুৎ দফতরের কৃষ্ণনগর ডিভিশনাল ম্যানেজার রাজু মণ্ডলের কথায়, ‘‘বর্ষাতেই নয়, সারা বছরই আমরা রাস্তার পাশে তারের উপরে ঝুঁকে থাকা গাছের ডাল কেটে দিই। কিন্তু অনেক সময়েই আমাদের বাধা পেতে হয়। ফলে বর্ষাতে বিপত্তি ঘটে।’’

বিদ্যুৎ দফতরের বহরমপুরের ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার সুকান্ত মণ্ডল বলেন, ‘‘কখনও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে অভিযোগ পেলে অথবা আমাদের যাতায়াতের পথে চোখে পড়লে দ্রুত ওই ঢাকনা লাগানোর ব্যবস্থা হয়। তবে বিদ্যুৎ দফতরের গাড়িতে কর্মীরা অনেক সময়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ান। সে রকম কোনও বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখলেই যাতে দ্রুত পদক্ষেপ করা যায় তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’ সেই নির্দেশ কি সবসময় মানা হচ্ছে?

বর্ষায় সন্ধ্যায় ফের বৃষ্টি নামে। সদুত্তর মেলে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

open electric death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE