Advertisement
E-Paper

বাবা-মা-ছেলে, ক্লাসে পড়া ধরলে হাত তুলছেন এক সঙ্গে

গ্রামের পিচ রাস্তা ধরে পাশাপাশি স্কুলমুখো তিনটে সাইকেল—একাদশ শ্রেণির তিন সহপাঠী বাবা,মা আর ছেলে! চেনা ছবিটার সঙ্গে সড়গড় হয়ে গিয়েছে নদিয়ার হাঁসখালির মামজোয়ান গ্রাম।

সৌমিত্র সিকদার

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:১৯
বাবা-মায়ের সঙ্গে বিপ্লব মণ্ডল।— নিজস্ব চিত্র

বাবা-মায়ের সঙ্গে বিপ্লব মণ্ডল।— নিজস্ব চিত্র

গ্রামের পিচ রাস্তা ধরে পাশাপাশি স্কুলমুখো তিনটে সাইকেল—একাদশ শ্রেণির তিন সহপাঠী বাবা,মা আর ছেলে!

চেনা ছবিটার সঙ্গে সড়গড় হয়ে গিয়েছে নদিয়ার হাঁসখালির মামজোয়ান গ্রাম।

পড়াশোনায় দাঁড়ি টেনে সেই কোন ছেলেবেলায় রুজির টানে স্কুলছুট হয়ে গিয়েছিলেন বলরাম মণ্ডল। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পড়াশোনায় ইতি টেনে দিয়েছিলেন স্ত্রী কল্যাণীও। মাধ্যমিক পাশ করা হয়নি। পড়াশোনার ইচ্ছেটা তবুও কোথায় যেন ‘ঘুন পোতার মতো’ তাড়া করত তাঁদের।

মধ্য চল্লিশে পৌছে মণ্ডল দম্পতি তাই রবীন্দ্রমুক্ত বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাশ করেন বছর দুয়েক আগে। এ বছর ছেলে বিপ্লবের সঙ্গে তাঁরা তিন জনেই উচ্চ মাধ্যমিকের পড়ুয়া।

নদিয়ার ধানতলার আড়ংঘাটা হাজরাপুর হাইস্কুলে কলা বিভাগের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন ওঁরা। বিষয় বাংলা, ইংরেজি, দর্শন, শিক্ষাবিজ্ঞান এবং ইতিহাস। স্কুল খুব কাছে নয়, বাড়ি থেকে প্রায় ছ’কিলোমিটার দূরে। বলরামবাবু বলছেন, ‘‘পড়া আর হয়ে ওঠেনি। তবে কষ্টটা ঘুন পোকার মতো তাড়িয়ে বেড়াতো জানেন।’’ স্ত্রী কল্যাণীকে জিজ্ঞাসা করায় তিনিও জানান, পড়ার ইচ্ছে রয়ে গিয়েছে তাঁরও। এ বার তাই এক সঙ্গে ফের নতুন করে শুরু করেছেন তাঁরা।

বলমারবাবু বলেন, ‘‘আগের চেয়ে আর্থিক অবস্থা একটু ফিরেছে। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে শেষতক তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, এক সঙ্গে পড়ব।’’ চাষের কাজ মিটিয়ে স্কুলের পথ ধরেন তিনি। কল্যাণীদেবীও সংসারের পাঁচটা কাজ সামলে, হেঁশেল টেনে তার পর পা রাখেন সাইকেলের প্যাডেলে। বলছেন, ‘‘সংসারে তিনটি মাত্র মানুষ। তিন জনেই স্কুলে থাকি। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে তবে খাওয়া। তবু কী যে তৃপ্তি বলে বোঝাতে পারব না!’’ তাঁদের পড়শিরাও এ ব্যাপারে বেশ সহমর্মী। পাশে রয়েছেন শিক্ষকেরাও। বলরামবাবু বলেন, ‘‘স্যারেরা সব সময় উৎসাহ দেন। অসুবিধা হচ্ছে কিনা, খোঁজ নেন। তাঁদের মুখ চেয়ে ভাল করে পাশ করতেই হবে।’’ রাতে সপরিবারে পড়তে বসেন তাঁরা। পড়া বুঝতে অসুবিধে হলে সহায় ছেলে বিপ্লব। বিপ্লবের তিন গৃহশিক্ষকও মা-বাবাকে সাহায্যা করেন।

বাবা-মার সঙ্গে স্কুলে যেতে কেমন লাগে? বিপ্লব জানাচ্ছে, ‘‘একই ক্লাসে পড়ায় আমাদের সুবিধা হয়েছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে কোনও বিষয় আলোচনা করে পড়লে সহজে পড়া বোঝা যায়।’’ স্কুলে এসে বয়সের ব্যবধান ভুলে যান মণ্ডল-দম্পতি। সহপাঠী সুপ্রিয়া বিশ্বাসের কথায়, ‘‘ওঁরা নিজেদের মতো লেখাপড়া করেন। আমাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলেন। পড়া বুঝতে অসুবিধা হলে জিজ্ঞাসা করেন। কোনও বাধা নেই।’’

আড়ংঘাটা স্টেশন থেকে সাড়ে আট কিলোমিটার দূরে চূর্নী নদীর কাছে হাজরাপুর হাইস্কুল। এখানে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় আটশো। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুজিতকুমার হোতা বলছেন, ‘‘ওই দম্পতি ছেলেকে ভর্তি করাতে এসেছিলেন। কিন্তু, ওঁদের পড়ার আগ্রহ দেখে ভর্তি করে নিয়েছি। এখন দেখছি সে দিনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না।’’

স্কুলের শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, ছেলের সঙ্গে বাবা-মায়ের প্রতিযোগিতাও রয়েছে বেশ। পড়াশোনায় একটু পিছিয়ে থাকলেও ছেলেকে বার্ষিক পরীক্ষার নম্বরে ছেলেকে পিছনে ফেলতে চান বলরামবাবু। তাঁরা জানাচ্ছেন, পড়া ধরলে এক সঙ্গেই হাত তোলেন ওঁরা। যা শুনে কল্যাণীদেবী বলছেন, ‘‘দেখি না, কে বেশি নম্বর পায়, বাবা ছেলে নাকি আমি!’’

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy