Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ধরা পড়েও মচকালেন না মৌটুসি

মেয়ের হদিস পেতে বাবা-মাকে আগেই তুলে এনেছিল পুলিশ। মেয়ে কোথায় তা জানেন না বলে প্রথমটায় দাবি করছিলেন তাঁরা। কিন্তু টানা জেরায় শেষে ভেঙে পড়েন।

থানায় নিয়ে আসা হল মৌটুসিকে। — সুদীপ ভট্টাচার্য

থানায় নিয়ে আসা হল মৌটুসিকে। — সুদীপ ভট্টাচার্য

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৬ ০২:০৬
Share: Save:

মেয়ের হদিস পেতে বাবা-মাকে আগেই তুলে এনেছিল পুলিশ।

মেয়ে কোথায় তা জানেন না বলে প্রথমটায় দাবি করছিলেন তাঁরা। কিন্তু টানা জেরায় শেষে ভেঙে পড়েন।

সেই সূত্র ধরে শুক্রবার নবদ্বীপ থেকে মৌটুসি দাসকে গ্রেফতার করে আনল পুলিশ। যদিও অনুষ্কাকে খুনের কথা তিনি অনেক রাত পর্যন্ত কবুল করেননি। তাঁর স্বামী অভিজিৎ দাস এবং শাশুড়ি কল্পনার সঙ্গে মুখোমুখি বসিয়ে কথা বের করার চেষ্টা হচ্ছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর।

গত সোমবার, অভিজিতের প্রথম পক্ষের মেয়ে সাড়ে ছ’বছরের অনুষ্কার মৃতদেহ শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরেই ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়েছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী মৌটুসি। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে নেওয়া হয়। পরের দিন সকালে সেখান থেকেই তিনি উধাও হয়ে যান। এর পরেই ঘূর্ণির কলুপাড়ায় নিজেদের বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে এলাকা ছাড়েন তাঁর বাবা-মা, গৌর ও মায়া বৈষ্ণব। এ দিন এলাকার কিছু লোকজন সেই বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছে। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

বিয়ের সাজে মৌটুসি

মঙ্গলবার পঞ্চায়েত কর্মী অভিজিৎ এবং তাঁর মাকে গ্রেফতার করেছিল কোতোয়ালি থানার পুলিশ। তাঁরা আপাতত পুলিশ হেফাজতে আছেন। অনুষ্কার মৃত্যুর ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে প্রথমে দাবি করলেও পরে ঠারেঠোরে মৌটুসিকেই দায়ী করতে শুরু করেন তাঁরা। ফলে, হন্যে হয়ে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা মৌটুসিকে খুঁজতে শুরু করে পুলিশও। কিন্তু নাগাল পাচ্ছিল না।

গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার রাতে নবদ্বীপের নতুন মায়াপুর এলাকায় মৌটুসির কাকা নারায়ণ বৈষ্ণবের বাড়িতে হানা দিয়ে পুলিশ গৌর ও মায়াকে আটক করে। কোতোয়ালি থানায় এনে দফায় দফায় তাদের জেরা করা হয় তাঁদের। প্রথমে তাঁরা দাবি করছিলেন, মৌটুসির ব্যাপারে তাঁরা কিছুই জানেন না। কিন্তু পরে জেরার মুখে তাঁরাই মৌটুসির হদিস দেন। গৌরবাবুকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে নবদ্বীপ থেকেই মৌটুসিকে পাকড়াও করেন কোতোয়া‌লি থানার আইসি সুব্রত সরকার।

ঘটনাচক্রে, অনুষ্কার মা প্রিয়াঙ্কা সরকারের বাড়িও নবদ্বীপেই। ২০০৮ সালে দেখেশুনে তাঁর বিয়ে হয়েছিল কৃষ্ণনগরের অভিজিতের সঙ্গে। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা অন্তঃসত্ত্বা হলে অভিজিৎ তাঁকে গর্ভপাত করানোর জন্য চাপ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। তিনি তা করেননি। অনুষ্কার জন্ম হয়। এর পরে সহকর্মী মৌটুসির সঙ্গে (তিনিও তখন পঞ্চায়েত অফিসে কাজ করতেন) বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে যান অভিজিৎ। বাড়িতেও তা জানাজানি হয়ে যায়।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল আগেই ধরেছিল। এর পরে তা আরও চওড়া হয়। ২০১৫ সালের জুনে অভিজিতের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ডিসেম্বরে অভিজিৎ বিয়ে করেন মৌটুসিকে। প্রিয়াঙ্কা গিয়ে আশ্রয় নেন বাপের বাড়িতে। তাঁর তেমন সঙ্গতি না থাকায় অনুষ্কাকে বাবার সঙ্গে থাকার অনুমতি দিয়েছিল আদালত। প্রিয়াঙ্কা যখনই চাইবেন, মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন বলে জানানো হয়েছিল। প্রিয়াঙ্কা যেতেনও। অনুষ্কা তাঁকে জানিয়েছিল, তাকে মারধর করা হয়। তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বায়নাও করেছিল।

পড়শিরা পুলিশকে যা জানিয়েছেন তাতে ছোট্ট অনুষ্কার সঙ্গে মোটেই ভাল ব্যবহার করতেন না মৌটুসি। তাকে ধারে-কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। ‘মা’ বলে ডাকলে সাড়াও দিতেন না। অনুষ্কা ঠাকুমার কাছেই থাকত। তিনি না পেরে উঠলে বাড়িওয়ালার স্ত্রী রূপা ও মা শিবাণী মেয়েটির দেখভাল করতেন। কিন্তু মৌটুসি ফিরেও তাকাতেন না বলে পুলিশ জেনেছে। রূপার দাবি, অভিজিৎ মেয়েকে যথেষ্ট ভালবাসতেন। তার অযত্ন নিয়ে মৌটুসির সঙ্গে তাঁর অশান্তি চলছিল। দ্বিতীয় বার বিয়ে করে তিনি ভুল করেছেন বলে ঘটনার আগের দিন, রবিবার রাতে আক্ষেপ করেছিলেন বলেও রূপার দাবি।

মৌটুসির বাড়িতে ভাঙচুর

সোমবার বিকেলে প্রতিবেশীরা জানতে পারেন যে অনুষ্কা গুরুতর অসুস্থ্ হয়ে পড়েছে। সেই অবস্থায় তাকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক ‘মৃত’ বলে জানিয়ে দেন। প্রথম থেকেই অভিজিৎ ও ঠাকুমা কল্পনা নানা বিভ্রান্তিকর কথা বলছিলেন। প্রথমে তাঁরা দাবি করেন, ঘুমন্ত আবস্থায় খাট থেকে পড়ে গিয়ে অনুষ্কার মৃত্যু হয়েছে। পরে আবার দাবি করেন, প্রিয়াঙ্কা ঠাকুমার পাশেই শুয়ে ছিল। বিকেলে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তাকে ডাকতে গিয়ে তিনি দেখেন, অনুষ্কা বালিশের উপরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। শরীর ঠান্ডা আর শক্ত হয়ে গিয়েছে। কল্পনার দাবি, গভীর ভাবে ঘুমিয়ে থাকায় তিনি বুঝতেই পারেননি কখন অঘটন ঘটল। অভিজিৎ দাবি করেন, অফিস থেকে ফিরে তিনি দেখেন, মেয়ে খাটের উপরে মায়ের পাশে শুয়ে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মায়ের চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে দেখেন মেয়ে নিথর হয়ে গিয়েছে। সে দিন মৌটুসি স্কুলে যাননি। সারা দিন বাডডিতেই ছিলেন। অনুষ্কা নড়ছে না জেনে পড়শিরা ছুটে এলেও তিনি ঘর থেকে বেরোননি। পরে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে দেহের ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। তবে শক্তিনগর পুলিশ মর্গের চিকিৎসক ময়নাতদন্ত না করে কলকাতায় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে দেহ পাঠিয়েছেন।

মৌটুসির বাপের বাড়ির পাড়ার লোকজন ও স্কুলের সহকর্মীরা আগেই জানিয়েছিলেন, তিনি কোনও দিনই কারও সঙ্গে বিশেষ মিশতেন না। কিন্তু কারও সঙ্গে কখনও খারাপ বা হিংস্র ব্যবহার করেছেন, এমনটাও শোনা যায়নি। এ দিনও তাঁর স্কুল, কামারহাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা জানিয়েছে, তিনি মোটেই ‘রাগী’ নন। পড়া না করলে বকতেন। বাড়ির কাজ করে না আনলে মাটিতে বসিয়ে দিতেন বা কান ধরে দাঁড় করাতেন। তবে তার বেশি কিছু নয়। চতুর্থ শ্রেণির দীপ খাসকেল, দ্বিতীয় শ্রেণির রনি পালেরা বলে, ‘‘দিদিমনি তেমন বকতেন না। পড়া না করলে শাস্তি দিতেন। খুব কড়া কিছু না।’’

এ রকম এক জন ‘দিদিমনি’ একটি শিশুকে খুন করতে পারেন?

পুলিশের দাবি, নবদ্বীপে পাকড়াও হওয়া ইস্তক গাড়িতে করে কৃষ্ণনগর নিয়ে আসার পথে পরে থানায় দফায়-দফায় জেরায় সব অভিযোগ অস্বীকার করে গিয়েছেন মৌটুসি। কিন্তু যদি তিনি কোনও ভাবেই জড়িত না হন, তা হলে পালালেন কেন?

তার উত্তর এখনও অজানা। তিন ধৃতকে এক সঙ্গে এবং আলাদা ভাবে জেরা করে পুলিশ জট ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। নদিয়ার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলেন, ‘‘মূল অভিযুক্ত মৌটুসি দাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সত্য জানার চেষ্টা চলছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Police child murder crime
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE