চৈত্রের শেেষই দুই জেলায় শুরু হয়ে গিয়েছে শীতের প্রস্তুতি। মানে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের নক-আউট ফুটবল টুর্নামেন্টের প্রস্তুতি। গত মরসুমে কোন দল ভাল খেলেছে, কোন ফুটবলার মাঠ কাঁপিয়ে গিয়েছে, সে সব নিয়ে এখন থেকেই বাছাইয়ের কাজ শুরু করে দিয়েছেন ক্লাব কর্তারা।
ফুটবল চিরকালই গ্রামবাংলার প্রাণ। কিন্তু গত কয়েক বছরে নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জ মেতে উঠেছে শীতকালীন ফুটবল উৎসবে। যে সব মাঠে এতদিন যাত্রার কনসার্ট বাজত, সে সব মাঠ এখন ফেটে পড়ে ‘গো-ও-ল’ চিৎকারে। প্রচার, প্যান্ডেল, ব্যবস্থাপনা সব কিছুই হুবহু যাত্রার মতো, শুধু পালার জায়গায় ফুটবল সাতসকালে গ্রামের মেঠোপথ ধরে বেরিয়ে পড়ে প্রচারের গাড়ি। মাইকে তারস্বরে প্রচার চলছে— ‘সংগ্রহ করুন সিজন কার্ড, চেয়ার কার্ড, জমিন টিকিট...। মহিলাদের বসার ও সাইকেল রাখিবার সুব্যবস্থা আছে।’ বিকেল নামতেই সাইকেল, মোটর বাইক আর কালো মাথা। যাত্রা-সিরিয়ালের ‘স্টারদের’ মতো ফুটবলের তারকাদের দেখতে হুড়োহুড়ি সামাল দেন ক্লাবের স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ।
বিকলনগরে স্থানীয় শ্যামাপ্রসাদ স্মৃতি সঙ্ঘের পরিচালনায় ডিসেম্বরে হয়ে গেল এমন নকআউট ফুটবল প্রতিযোগিতা। গ্রামে খেলার মাঠ নেই। তাই গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে একটি সাড়ে পাঁচ বিঘে চাষের জমি ভাড়া নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল খেলার মাঠ। গোটা মাঠ ঘিরে প্রায় ১০ ফুট উঁচু বাঁশ ও তার্পোলিন। আশপাশের বাড়ির মালিককেও সবিনয় অনুরোধ করা হয়েছিল, বাইরের কেউ যেন ছাদে উঠে খেলা না দেখে। টিকিটের ব্যাপার রয়েছে যে! মাঠের বাইরে একপাশে সাইকেল ও মোটর সাইকেল রাখার জায়গা। চেয়ার-টেবিল পেতে অস্থায়ী টিকিট কাউন্টার। খেলার দিনগুলোতে প্যান্ডেলের ভিতরে হাজির কয়েকজন বাদাম ও চানাচুর বিক্রেতাও। তাঁরাও জমিন টিকিট কেটেছেন। রথ দেখা, কলা বেচা, দুই-ই চলছে। মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া, ধরমপুর, তক্তিপুর, সাগর পাড়া, নদিয়ার শিকারপুর, কালীগঞ্জ এলাকাতেও এই একই কায়দায় ফুটবল প্রতিযোগিতা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর।
অথচ বছর কয়েক আগেও গোটা শীতকাল জুড়ে গাঁগঞ্জের মাঠে দাপিয়ে চলত যাত্রাপালা। খেতের ফসল ঘরে উঠে গেলে মানুষের হাতে কিছু পয়সা আসে। পুজোর মরসুমের পরে কোনও বিনোদনও থাকে না। এই ছিল যাত্রার সময়। শ্যামাপ্রসাদ স্মৃতি সঙ্ঘ বার কয়েক যাত্রার আয়োজন করেছিল। কিন্তু কর্মকর্তারা যাত্রা থেকে সরে এসেছেন। বরং তাঁরা বেশি আগ্রহী ফুটবল নিয়ে। কেন? ওই ক্লাবের সম্পাদক রক্ষিত মণ্ডল বলছেন, “যাত্রায় এখন দর্শক কমে গিয়েছে। বাজেটের পাশাপাশি ঝুঁকি ও ঝক্কি দুটোই বেড়েছে। তার থেকে এই ধরনের ফুটবল অনেক ভাল। বাজেট কম।’’ ভাল খেলোয়াড় বাছতে পারলে লোকসানেরও ভয় নেই।’’ ডোমকল স্পোর্টিং ক্লাবের সম্পাদক দেবাংশু সরকার বলছেন, ‘‘গত শীতে আমরা যাত্রার আয়োজন করেছিলাম। এত কম দর্শক হয়েছিল যে মঞ্চের সামনের সারির আসনও ভর্তি হয়নি। বিস্তর লোকসান হয়েছে। তাই পণ করেছি, আর যাত্রা নয়। ফুটবল ঢের ভাল।’’
সিরিয়াল, সিনেমার বাড়বাড়ন্তে যাত্রার জৌলুস কমতে শুরু করেছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। সিনেমা, সিরিয়ালের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে বিচিত্রানুষ্ঠান কিংবা নাইট উৎসবের রমরমায় গ্রামে-গঞ্জে যাত্রা রীতিমতো ধুঁকতে শুরু করে।
কী ভাবে চলছে ফুটবল-যাত্রা?
উদ্যোক্তারা জানান, খেলোয়াড়রা বেশির ভাগই কলকাতার। কয়েক জন নাইজেরিয়ান ফুটবলারও আছেন। রেফারি ও লাইনসম্যানও আনা হচ্ছে কলকাতা থেকে। রক্ষিতবাবু বলছেন, “টিকিট কেটে লোকজন ভিড় করছেন খেলার মাঠে। ভাল খেলোয়াড় না হলে পুরো আয়োজনটাই তো মাঠে মারা যাবে। তাই প্রত্যেক দলকেই আমরা বলেছিলাম, ভাল খেলোয়াড় আনতে হবে।” খেলার দিন সকাল সকাল আসছেন ‘স্টার’ খেলোয়াড়রা। গ্রামেরই এক বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছেন, আর এক বাড়িতে খাওয়ার আয়োজন। তারপর মাঠ থেকে চলে আসছে প্রচারের গাড়ি। তাতে ফুটবলাররা যাচ্ছেন মাঠে। ঠিক যে ভাবে যাত্রা শুরুর আগে স্টাররা মঞ্চের পিছনে সাজঘর পর্যন্ত যান।
ততক্ষণে প্যান্ডেলের গেটে এসে ভিড় করেছেন দর্শকরা। প্যান্ডেলের উপরে বসে রয়েছে জনা কয়েক কিশোর। তারা অবশ্য খেলা দেখার পাশাপাশি নজর রাখছে দর্শকদের সাইকেল ও মোটর সাইকেলের উপরে। শীতের বিকেলে এক ঘণ্টার খেলা শেষ হতেই ফের মাইকে প্রচার—‘পরের খেলায় কলকাতা থেকে আসছেন নাইজেরিয়ান ফুটবলার। নির্দিষ্ট সময়ে মাঠে এসে আসন দখল করুন।’ যাত্রার কথা মনে পড়িয়ে দিয়ে জমিয়ে চলছে ফুটবল উৎসব!
ডোমকল স্পোর্টিং ক্লাবের পক্ষে সম্পাদক দেবাংশু সরকার জানান, এখন থেকে ভাল ক্লাব বা খেলোয়াড় বাছাইয়ের কাজ সেরে রাখতে হচ্ছে। না হলে শেষ মুহূর্তে ভাল খেলোয়াড় হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। আর ফুটবলে স্টার খেলোয়াড় না আনতে পারলে আয়োজন মাঠে মারা যাবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy