ছবি: সংগৃহীত
সকালের ধুমায়িত কাপ থেকে ওঠা চায়ের সুবাস কিছুদিন ধরেই পাচ্ছেন না দীপক সরকার। অথচ তাঁর ওই একটিই নেশা। ভাল চায়ের জন্য হাজার-দেড় হাজার টাকা কেজিতেও পরোয়া নেই।
সেই চায়ে গন্ধ না পেয়ে প্রথমে খানিক ঘাবড়ে গিয়েছিলেন অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক। করোনার প্রাথমিক লক্ষণ নাকি স্বাদগন্ধ চলে যাওয়া। পরে খেয়াল করলেন, ব্যাপারটা তেমন নয়। অন্য খাবারের স্বাদগন্ধ বিলক্ষণ পাচ্ছেন। সমস্যা কেবল মাত্র চায়ের কাপে। ছুটলেন তিনি বহু দিনের পুরনো দোকানে। বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে বুঝলেন, এর পিছনেও করোনা আছে। করোনার কারণেই স্বাদগন্ধ হারিয়েছে সাধের চা পাতা!
গত ছ’মাসে বাজারে চায়ের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। খুচরো এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, প্রতি সপ্তাহে বেড়েছে চায়ের দাম। এপ্রিল থেকে দাম বাড়তে বাড়তে মাঝ সেপ্টেম্বরে এসে প্রতি কেজি চায়ের দাম গুণগত মান অনুসারে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এবং দাম বৃদ্ধি পাওয়ার এই প্রবণতা সহসা বন্ধ হওয়ার নয় বলেই তাঁদের অনুমান। ফলে কয়েক মাস আগে যে চা পাতা ৮০০ টাকা কেজি দরে কেনা যেত, সেই পাতা কিনতে এখন প্রায় ১১০০ টাকা দিতে হচ্ছে।
কিন্তু কেন এমন বাড়ছে চায়ের দাম? সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, মার্চের শেষ থেকে মে পর্যন্ত টানা লকডাউনের জেরে চা বাগান বন্ধ ছিল। ফলে চায়ের উৎপাদন বিপুল ভাবে ধাক্কা খেয়েছে। যার পরিণতিতে বাজারের এই অবস্থা। তাই দারুণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আর স্বাদগন্ধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
কৃষ্ণনগরের চা ব্যবসায়ী দীপেন কর বলেন, “যে সময়ে নতুন চা পাতা ওঠার কথা, সেই সময়ে লকডাউন চলছিল। তাই বাগান বন্ধ ছিল। উৎপাদনও বন্ধ ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই বাজারে টান পড়ছে। আর টান পড়লেই দাম বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে নেপাল থেকে আসা চা কিছুটা হলেও বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। না হলে এত দিনে দাম আরও বেড়ে যেত।” বাজারে দু’রকমের চা সাধারণত বিক্রি হয়— সিটিসি এবং সুগন্ধী পাতা চা। সেই সিটিসি ১৫০ টাকা বেড়েছে কেজি প্রতি। দার্জিলিং বা অসমের চা আরও বেশি।
প্রায় নব্বই বছর ধরে কয়েক প্রজন্মের চায়ের ব্যবসা সুখেন সরকারের। তিনি জানান, প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চে যে নতুন চা ওঠে তাকে বলা হয় ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’। এই চায়ের উপরে নির্ভর করে দেশীয় বাজারের কেনাবেচা। স্বাদ, গন্ধ, গুণগত মান সব কিছুই এর উপরে নির্ভর করে। পাইকারদের সারা বছরের ব্যবসা নির্ভর করে ওই ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ চায়ের উপরে। জুন-জুলাই মাসে ওঠে ‘সেকেন্ড ফ্লাশ’, যে চা অতি উৎকৃষ্ট। মূলত বিদেশে রফতানি হয় ওই চা। এ ছাড়া বড়-বড় বহুজাতিক সংস্থা যারা প্যাকেটজাত চায়ের কারবার করে, তারা প্রধানত ওই চায়ের ক্রেতা। তবে কিছু বড় পাইকারও ‘সেকেন্ড ফ্লাশ’ পাতা কেনেন, যা দিয়ে তাঁরা দোকানের সুনাম ধরে রাখেন।
সুখেন সরকার বলেন, “লকডাউনে বাগান বন্ধ থাকায় ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ চা একেবারেই পাওয়া যায়নি। ফলে বাজারে বিরাট ঘাটতি রয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ৪০ শতাংশ চা কম উৎপাদন হয়েছে। দামটা সেই কারনেই বাড়ছে। সেই সঙ্গে দার্জিলিংয়ের বাগান বন্ধ থাকায় বা অসমের চা না পাওয়ায় সুগন্ধী চা পাতা অমিল। সামাল দিতে দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি অঞ্চলের চা কিনতে হয়েছে। যে কারণে চায়ের চেনা স্বাদ পাচ্ছেন না ক্রেতারা।”
ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, চায়ের দাম ঠিক হয় নিলামের মাধ্যমে। কিন্তু লকডাউনের জন্য সব ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। নিলাম ধরতেই পাচ্ছেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ়ের যুগ্ম সম্পাদক গোকুলবিহারী সাহা বলেন, “ সত্যি কথা বলতে গেলে, চাল-ডালের পরেই মানুষ কেনেন চা। সেই চায়ের দাম বাড়ছে অথচ স্বাদ কমছে। এতে ছোট ব্যবসায়ীরা শেষ হয়ে যাচ্ছেন।”
লকডাউনের আগে খুচরো দোকানে সিটিসি চায়ের ন্যূনতম দাম ছিল ১২০ টাকা। শুক্রবার কলকাতায় নিলামে সিটিসির দর ছিল ২০০-২৪০ টাকা কেজি। ১২ শতাংশ কর দিয়ে, পরিবহণ ভাড়া দিয়ে সেই চা দোকানদারের কেনা পড়ছে ২৭০ টাকা প্রায়। স্বাভাবিক ভাবেই বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি দরে।
এ ভাবে চললে ‘চা-তাল’ বাঙালি গলা শুকিয়েই মরবে, সন্দেহ নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy