Advertisement
E-Paper

শান্তিপুরে রথে প্রধান বিগ্রহ রঘুনাথ

বঙ্কিমের রাধারানি পথ হারিয়েছিল মাহেশের রথের মেলায়। বৈষ্ণবতীর্থ শান্তিপুরে রথের মেলায় পর্যটক দিশা হারাতে পারেন মেলা রথের ভিড়ে।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৬ ০১:৫৫
শান্তিপুরের রাধাকান্ত জিউ মন্দিরে রঘুনাথ বিগ্রহ। — নিজস্ব চিত্র।

শান্তিপুরের রাধাকান্ত জিউ মন্দিরে রঘুনাথ বিগ্রহ। — নিজস্ব চিত্র।

বঙ্কিমের রাধারানি পথ হারিয়েছিল মাহেশের রথের মেলায়। বৈষ্ণবতীর্থ শান্তিপুরে রথের মেলায় পর্যটক দিশা হারাতে পারেন মেলা রথের ভিড়ে।

স্থানীয় ইতিহাস বলে সে সব রথের কোনওটির বয়স আড়াইশো বছরেরও বেশি। কেউ আবার যাত্রা করে এসেছে দুশো কিম্বা দেড়শো বছরের সুদীর্ঘ পথ। শতবর্ষ অতিক্রম করা রথের সংখ্যাও কম নয়। গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের প্রাচীন জনপদ শান্তিপুরের পথে রথযাত্রার দিনে উত্তর থেকে দক্ষিণে কিংবা পূর্ব থেকে পশ্চিমে এক সঙ্গে সব রথ পথে নামে। সেদিন সময় যায় থমকে, পথিক পথ হারায়।

রাস থেকে রথযাত্রা, যে কোন বৈষ্ণবীয় উৎসব শান্তিপুর উদযাপন করে স্বতন্ত্র ঘরানায়। সেই নিজস্ব নিয়মেই শান্তিপুরের রথযাত্রাও ভিন্ন স্বাদে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে কয়েক শো বছর ধরে। কি সেই বৈশিষ্ট্য?

ভূ-ভারতে সর্বত্র রথযাত্রা মানেই জগন্নাথ দেব। সেখানে চৈতন্যপার্ষদ অদ্বৈতাচার্যের সাধনপীঠ শান্তিপুরের রথযাত্রা প্রধানত ‘রঘুনাথের’ রথযাত্রা। শহরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রথগুলির প্রতিটিতেই রামচন্দ্রের গুরুত্ব জগন্নাথদেবকে ছাপিয়ে গিয়েছে এখানে। শান্তিপুরের সবচেয়ে প্রাচীন বড়গোস্বামী বাড়ি, মধ্যম বা হাটখোলা গোস্বামী বাড়ির রথ কিংবা সাহাবাড়ির প্রাচীন রথে প্রধান বিগ্রহ হিসাবে শোভা পায় রঘুনাথ বা রামচন্দ্রের মূর্তি। সঙ্গে জগন্নাথদেব থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জগন্নাথদেব একা। বলভদ্র এবং সুভদ্রা দেবী অনুপস্থিত এখানে।

কিন্তু বৈষ্ণবক্ষেত্র শান্তিপুরে রামচন্দ্র কী ভাবে রথের প্রধান দেবতা হয়ে উঠলেন, এ নিয়ে কোনও স্পষ্ট ধারণা মেলে না। অদ্বৈতাচার্যের বংশধর বিভিন্ন গোস্বামী বাড়িতে রয়েছে দুর্লভ সব কৃষ্ণবিগ্রহ।
যাঁদের নিয়ে শান্তিপুরের সুবিখ্যাত ভাঙ্গারাস অনুষ্ঠিত হয়। রথযাত্রায় সেই সব বিগ্রহের প্রাধান্য থাকলেও কথা ছিল। তার বদলে কেন রঘুনাথ তথা রামচন্দ্রের বিশালাকায় বিগ্রহের কেন রথযাত্রা হয়, সে নিয়ে কৌতূহলের জবাবে নীরব স্থানীয় ইতিহাসও। বড়গোস্বামীর বাড়ির সত্যনারায়ণ গোস্বামী কিংবা রাধাকান্ত জিউ মন্দিরের প্রবীণ জওহরলাল সাহা প্রমুখেরা জানান চিরাচরিত ভাবে শান্তিপুরের রথযাত্রা মানেই রঘুনাথের রথ। পুরুষানুক্রমে এমনটাই হয়ে আসছে। কিন্তু
কেন, তার কোনও ব্যাখ্যা তাঁদের কাছেও নেই।

শান্তিপুর শহরের খুঁটিনাটির খোঁজখবর রাখা কবি স্বপন রায় এই প্রসঙ্গে বলেন, “কোন পাথুরে প্রমাণ না থাকলেও এমনটা হতে পারে যে, ফুলিয়ার কৃত্তিবাসকে স্বীকৃতি দিতেই রামের গুরুত্ব বেড়েছে।” তাঁর যুক্তি ফেলে দেওয়ার মতো নয়। শান্তিপুরের সবচেয়ে প্রাচীন রথটি বের হয় বড় গোস্বামী বাড়ি থেকে। পরিবার প্রধান সত্যনারায়ণ গোস্বামী জানান, “আমাদের পরিবারের রথের বয়স আনুমানিক তিনশো বছর। রথের প্রধান দেবতা রঘুনাথ। সঙ্গে জগন্নাথদেব। তবে শুধু আমাদের পরিবার বলে নয়, শান্তিপুরের যতগুলি প্রাচীন রথ আছে তার সব ক’টিতেই রঘুনাথের মূর্তি প্রধান।” সত্যনারায়ণবাবু জানিয়েছেন বড়গোস্বামী বাড়ির আদি রথটি ছিল লোহার এবং প্রায় পঞ্চাশ ফুট উচ্চতার। দেড়শো বছর আগে সেটি নষ্ট হয়ে যায়। পড়ে একটি কাঠের অপেক্ষাকৃত ছোট রথ বের হত। সেটিও বছর তিরিশেক আগে নষ্ট হয়ে গেলে ফের একটি লোহার রথ তৈরি করানো হয়েছে। এখন রথের দিন সেই রথেই রঘুনাথ চড়েন। সত্যনারায়ণ বাবু জানিয়েছেন পরিবারের এক সদস্য ব্রজেন্দু গোস্বামীর করা বিশেষ নকশার ওই রথে এমন ব্যবস্থা করা আছে, যাতে করে বিরাট রঘুনাথ মূর্তিকে ‘চেন-পুলি’ দিয়ে হাওদা সমেত রথে তুলে ফেলা যায়। যার অর্থ রঘুনাথের গুরুত্বই সর্বাধিক।

আরও লক্ষ্যণীয় শান্তিপুরের সবকটি রঘুনাথ বিগ্রহ একই ভঙ্গির। রামচন্দ্রের বসে থাকা মূর্তি। এই বিশেষ ভঙ্গির মূর্তিও সচরাচর দেখা যায় না। যার অর্থ হয়ত বড় গোস্বামী বাড়ির অনুসরণে পরবর্তী কালে অন্য বিগ্রহ বাড়িতেও একই ধরনের মূর্তি গড়া হয়েছিল। হয়ত সমবেত প্রতিবাদের মাধ্যম হয়ে উঠেছিলেন রঘুনাথ তথা রামচন্দ্র।

অন্যদিকে শান্তিপুরের গোস্বামীদের অনুসারী ভক্ত জমিদার হীরালাল সাহাও দেড়শো বছর আগে রথযাত্রা প্রচলন করেন। বড় এবং মধ্যম গোস্বামী বাড়ির পরেই এটি শান্তিপুরের সব থেকে প্রাচীন রথ। বর্তমান পরিবার প্রধান ছিয়াত্তর ছুঁইছুঁই জহরলাল সাহা বলেন, “আমি হীরালাল সাহার চতুর্থ পুরুষ। প্রচলন হীরালাল করলেও উৎসবকে জমজমাট করে তোলেন কুঞ্জবিহারী সাহা। ১৬ ফুট লম্বা কাঠের রথ একদা শান্তিপুরের রাস্তায় নামত সাহাবাড়ির রাধাকান্ত জিউর মন্দির থেকে। এখন তার বদলে নামে লোহার রথ।”

শান্তিপুরের গোকুলচাঁদের রথ যেটি মধ্যম গোস্বামী বা হাটখোলা গোস্বামী বাড়ি থেকে বের হয়, সেটিও আরও এক প্রাচীন রথ। এখানেও প্রধান রথী রঘুনাথ।

Raghunath Santipur Rath Yatra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy