Advertisement
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

পড়ার ফাঁকেই ছুটে যাওয়া প্রত্যন্ত গ্রামে

‘অমন খটমট নামই শুনি নাই গো’, থ্যালাসেমিয়া হলে, পড়শি গ্রামের জাঁদরেল ওঝা এসে তাই পথ্য দিয়ে যান হলুদপোড়া। আর, গোয়ালের গরু হারালে তলব হয় গুনিনের। ডাক্তার, পুলিশ, পঞ্চায়েত থেকে বহু দূরের এক একটা নিঃস্তরঙ্গ গ্রাম। হালের দুনিয়া থেকে মুখ ফেরানো সেই সব গ্রামকে ‘দত্তক’ নিয়ে গড়েপিঠে তুলছে স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা। নদিয়া-মুর্শিদাবাদের দত্তক-গ্রামে পা রাখল আনন্দবাজার— প্রথম পর্বকথা বলতে গিয়ে ঠোঁট দু’টো কাঁপছিল মামনির। কোলের মেয়েটা নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। কত আর বয়স হবে? চার কি পাঁচ। শীর্ণ চেহারা, ফ্যাকাসে গায়ের রং। এই বয়েসে কী যুদ্ধটাই না লড়তে হচ্ছে তাকে, বোঝাই যায়।

সাফাই-অভিযান: চাঁদপুরে পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র

সাফাই-অভিযান: চাঁদপুরে পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র

সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৭ ০১:৩২
Share: Save:

কথা বলতে গিয়ে ঠোঁট দু’টো কাঁপছিল মামনির।

কোলের মেয়েটা নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। কত আর বয়স হবে? চার কি পাঁচ। শীর্ণ চেহারা, ফ্যাকাসে গায়ের রং। এই বয়েসে কী যুদ্ধটাই না লড়তে হচ্ছে তাকে, বোঝাই যায়।

থ্যালাসেমিয়ায় ভুগছে বছর পাঁচেকের অঙ্কিতা। মেয়ের গায়েমাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মামনি সর্দার বললেন, “জনে জনে সব্বাইকে বলেছিলাম, রক্তটা পরীক্ষা করিয়ে নিতে। যাতে আমার মতো ভুল কারও না হয়। কিন্তু শুনল না কেউ।”

জন্মের পর থেকেই অঙ্কিতার সর্দি-কাশি লেগে থাকত। শরীরটাও কেমন ধারা সাদা হয়ে যাচ্ছিল। মেয়েকে নিয়ে তাই মামনি আর সুখেন ছুটেছিল টাউনে। বহু পরীক্ষার পরে ডাক্তারবাবু জানিয়েছিলেন, তাঁদের সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। আঁচলের খুট দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘‘ডাক্তারবাবু সে দিন বলেছিলেন, গ্রামে গিয়ে সবাইকে জানাতে, শরীরে ‘বিষ’ আছে কি না সেটা রক্ত পরীক্ষা করে জেনে নিয়ে বিয়ে দিতে। ফিরে এসে বাড়ি বাড়ি ঘুরেছে মামনি। সবাইকে বলেছে রক্তের ভিতরে সেই ‘কাল বিষের’ কথা। কোনও ফল হয়নি।’’

মামনি ব্যর্থ হলেও পিছু হটতে রাজি নয়, আসাননগর মদনমোহন তর্কালঙ্কার কলেজের পড়ুয়ারা। বুধবার থেকে তারা ভীমপুর এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম চাঁদপুরের বাড়ি ঘুরে জঞ্জাল পরিষ্কারের পাশাপাশি প্রচার করছে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে। বলছে, “বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে নিন পাত্রপাত্রীর। না হলে অঙ্কিতার মতো হতে পারে।”

অন্তত সাড়ে ছ’হাজার মানুষের বাস এ গ্রামে। দরিদ্র পরিবারগুলোয় না আছে অর্থ, না আছে ন্যূনতম সচেতনতা। কয়েক দিন আগেও রোগ-বালাইয়ের মোকাবিলা বলতে তাঁরা বুঝতেন ঝাড়ফুঁক। সেই গ্রামে থ্যালাসেমিয়া নেহাতই রক্তের দোষ বলে মনে করেন অনেক মানুষ। আর তাই জাতীয় সেবা প্রকল্পের জন্য এই চাঁদপুরকে বেছে নিয়েছিলেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁরা ওই থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুটির কথা জানতে পারেন। তাঁরা দেখেন গ্রামে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু থাকলেও এই নিয়ে কোনও ধারণাই নেই কারও। তখনই ঠিক হয় স্বাস্থ্য-চক্ষু পরীক্ষা শিবিরের পাশাপাশি বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া হবে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে।

সেই মতো প্রতি দিনই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কলেজের প্রায় ৫০ জন ছাত্রছাত্রী গ্রামে গিয়ে কোদাল-ঝুড়ি নিয়ে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করছে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে। গত কাল, সোমবার রানাঘাটের একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আসা হয়েছিল। শিবির করে থ্যালাসেমিয়ার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়। ৩১৭ জনের রক্ত পরীক্ষা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি রিপোর্ট পৌঁছে দেওয়া হবে।

কলেজের অধ্যক্ষ অশোককুমার দাস বলেন, “গ্রামটাকে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত করতে চাই। তাই প্রচারের পাশাপাশি এই আয়োজন।”

সব শুনে মামনি বলে, “আমার রক্তটা যদি একটু পরীক্ষা করত বিয়ের আগে...।” আফসোস করে মামনি। আর তার সেই দীর্ঘশ্বাস শুনে গোটা গ্রাম যেন বলে ওঠে, “যাব যাব। আমরা এ বার রক্তপরীক্ষা করাতে শিবিরে যাব।”

অন্য বিষয়গুলি:

Remote village College Students Cleaning
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy