Advertisement
E-Paper

গোল বাঁচাতেন, ছাত্র গড়তেন হুইলার সাহেব

তিনিই ছিলেন কলেজ টিমের গোলকিপার। আবার ছাত্রদের কারও মাথায় যন্ত্রণা হলে মাথা টিপে দিতেন তিনি। আবার কোনও ক্লাসে অধ্যাপক না এলে তিনিই ক্লাস নিতেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের কিংবদন্তি অধ্যক্ষ রেভারেন্ড এডওয়ার্ড মন্টেগো হুইলার এমনই ব্যতিক্রমী শিক্ষক ছিলেন। প্রবাদপ্রতিম মানুষটির ১৫১ তম জন্মদিন বুধবার ৩ সেপ্টেম্বর নীরবেই কেটে গেল। তাঁর স্মৃতিতে ১৯২১ সালে চালু হয়েছিল ‘হুইলার শিল্ড’ ফুটবল প্রতিযোগিতা। সে-ও নিয়মিত খেলা হয়েছে ১৯৮৯ সাল অবধি।

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:০৫
হুইলার সাহেব।

হুইলার সাহেব।

তিনিই ছিলেন কলেজ টিমের গোলকিপার। আবার ছাত্রদের কারও মাথায় যন্ত্রণা হলে মাথা টিপে দিতেন তিনি। আবার কোনও ক্লাসে অধ্যাপক না এলে তিনিই ক্লাস নিতেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের কিংবদন্তি অধ্যক্ষ রেভারেন্ড এডওয়ার্ড মন্টেগো হুইলার এমনই ব্যতিক্রমী শিক্ষক ছিলেন। প্রবাদপ্রতিম মানুষটির ১৫১ তম জন্মদিন বুধবার ৩ সেপ্টেম্বর নীরবেই কেটে গেল। তাঁর স্মৃতিতে ১৯২১ সালে চালু হয়েছিল ‘হুইলার শিল্ড’ ফুটবল প্রতিযোগিতা। সে-ও নিয়মিত খেলা হয়েছে ১৯৮৯ সাল অবধি। তারপর প্রয়াত আইনজীবী সুব্রত সমাজদারে উদ্যোগে মাত্র দু’ বার ২০০২ সালে এবং ২০০৫ সালে শেষ বারের মতো হুইলার শিল্ডের খেলা হয়। এমনকী তাঁর নিজের প্রাণের কলেজেও তাঁর জন্মোত্‌সব হল না। কেন? ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কল্যাণাক্ষ ঘোষের ব্যাখ্যা, “কোনও দিনই হয়নি। তাই এ দিনও হল না।”

অথচ বিশ শতকের গোড়ার দিকে হুইলার সাহেবের নেতৃত্বে কৃষ্ণনাথ কলেজের ফুটবল টিম অবিভক্ত বাংলায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জন করেছিল। ১৯০৬ সাল থেকে শুরু করে ১৯১৫ সালে জীবনাবসানের আগে পর্যন্ত তিনি নিজে ওই টিমের গোলরক্ষক ছিলেন। কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র ছিলেন কবি কালিদাস রায়। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত কৃষ্ণনাথ কলেজের শতবাষির্কী গ্রন্থে কবিশেখর কালিদাস রায় লিখেছেন, “ছাত্ররা সকালে উঠিয়া পড়িতে বসিয়াছে কিনা ছাত্রবাসে গিয়ে দেখিতেন। রাত্রি দশটা বাজিলে নিজে গিয়া তাহাদের আলো নিভাইয়া দিতেন। বৈকালে গিয়া ছাত্রাবাস হইতে ছাত্রদের খেদাইয়া বাহির করিতেন। তাহারা সকলে খেলুক-না-খেলুক খেলার মাঠের দিকে সকলকে লইয়া যাইতেন। ছুটির দিনে নিজের বাংলোতে ছেলেদের পড়াইবার জন্য ডাকিয়া লইতেন।”

ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল ছাড়াও ব্যাডমিনটন ও টেনিস খেলতেন তিনি। ওই খেলার সূত্রেই এক মজার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন রাজশাহি কলেজের প্রয়াত অধ্যাপক কৌশিকনাথ ভট্টাচার্য। কৃষ্ণনাথ কলেজের এই প্রাক্তনীর স্মৃতিচারণা, “রাজশাহি কলেজের সঙ্গে কৃষ্ণনাথ কলেজের ফুটবল প্রতিযোগিতা। হাফ টাইমের সময় খেলোয়াড় হুইলার সাহেব আমাকে দেখতে পেয়ে সবার সামনে আমার দু’ কান মলে দিয়ে বললেন, ‘স্টিমারঘাটে আমাদের নিতে যাওয়ার কথা ছিল, তুমি যাওনি কেন?’ আমি ক্ষমা চেয়ে বললাম, ‘তখন আমি কলেজে ছাত্রদের পড়াতে ব্যস্ত ছিলাম।’ হো হো করে হেসে পিঠ চাপড়িয়ে বললেন, ‘ভেবেছিলাম, মাই বয় আমাদের ভুলেই গিয়েছে।” আচার্যের এই স্নেহের কথা বারবার তুলে ধরেছেন তাঁর ছাত্ররা।

এখন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ।—নিজস্ব চিত্র।

কালিদাস লিখেছেন, “আমাদের এফ এ পরীক্ষা চলছে। এক হাতে বুক চাপিয়া ধরিয়া অন্য হাতে লিখিতেছিলাম। মুখে আমার ক্লেশের চিহ্ন। সাহেব হলে আসিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে আমার কাছে আসিয়া আমার অবস্থা দেখিয়া পরীক্ষা হলের ভারপ্রাপ্তকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ওয়ান চেয়ার প্লিজ, ফর দিস বয়!’ ... তারপর দপ্তরির হাত হইতে নিজেই চেয়ার লইয়া আনিয়া আমাকে বসাইলেন এবং আমার মাথায় হাত বুলাইয়া আমাকে উত্‌সাহিত করিলেন। ট্যাবলেট আনিয়া আমাকে খাওয়াইলেন। বার বার আমার কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলন, ‘হাউ ডু ইউ ফিল, মাই বয়? পরদিন দশটার সময় আসিয়া প্রথমেই আমার শরীরের খোঁজ নিলেন।” ছাত্রদের স্মৃতিচারণায় জানা যায়, ছাত্রাবাসে কোনও ছাত্র অসুস্থ হলে দু’বেলা তাঁদের খোঁজ করতেন হুইলার। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। বহরমপুরের প্রয়াত আইনজীবী কালিকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তখন হুইলার সাহেবের ছাত্র। ভাগীরথীতে স্নান করে কালিকুমার নদীপাড়ে ধ্যানমগ্ন। এক ইউরোপিয়ানের ভিস্তিওয়ালা কালিকুমারের গায়ে জল ঢেলে দেয়। প্রতিবাদ করলে ওই ভিস্তিওয়ালা ও তার সঙ্গী এক দর্জি মিলে কালিকুমারকে মারধর করে। সে কথা শুনে প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে হস্টেলের ছেলেরা দল বেঁধে ওই সাহেবের কুঠিতে চড়াও হয়। ঘটনায় উত্তেজিত পুলিশ সুপার ডিকেন্স ছাত্রদের চিহ্নিত করার জন্য এক পুলিশ অফিসারকে ছাত্রাবাসে পাঠান। শুনেই ছুটে যান হুইলার। প্রাক্তনী তথা রাজশাহি কলেজের প্রয়াত অধ্যাপক কৌশিকনাথ ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণা, “পুলিশ অফিসারকে ঘাড় ধরে হস্টেলের বারান্দা থেকে ফেলে দিয়ে হুইলার বলেন, “ফিরে গিয়ে এস পি বলো, দ্যাট ডিকেন্স অ্যান্ড ডাঙ্কি বিগিন উইথ দ্য সেম লেটার ‘ডি’। আর এক প্রাক্তনী তথা সুরেন্দ্রনাথ কলেজের প্রয়াত অধ্যাপক বিনোদবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কোনও অধ্যাপক অনুপস্থিত থাকেলও কোনও ক্লাসের পাঠদান বন্ধ হত না। সপ্তাহে ২৬টি ক্লাস ছাড়াও তিনি অনুপস্থিত অধ্যাপকের ক্লাস নিতেন। ইংরাজি সাহিত্য ছাড়াও তিনি পড়াতেন লজিক, ইতিহাস, দর্শন, বোটানি ও ইকনমিক্স।”

ছাত্রঅন্ত প্রাণ আচার্য হুইলারের পাঠদানের পদ্ধতিও ছিল ধরাবাঁধা ছকের বাইরে। কৌশিক লিখছেন, “ওয়াডর্সওয়ার্থের কাব্যগ্রন্থ পড়াতে গিয়ে তিনি পড়ালেন না। বললেন, ‘শীতকালে পড়াব।’ শীতকালে বেশ কয়েক রকমের ফুলে বোঝাই গাছ-সহ টব নিয়ে ঢুকলেন ক্লাসের ভিতর।” কবিতায় থাকা ফুলের সঙ্গে চাক্ষুস পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি কাব্যরস বিতরণ করলেন। পাঠ্য তলিকায় শেক্সপিয়রের নাটক ছিল না। ছিল ওয়াল্টার র্যালের শেক্সপিয়র। তাই কাজ বাড়ল তাঁর। কয়েক মাস পাঠক্রম বর্হিভূত শেক্সপিয়রের নাটক পড়ানোর পর তিনি ছাত্রদের পড়ালেন ওয়াল্টার র্যালের শেক্সপিয়র। হুইলারের মন্তব্য, “মহাকবির নাটক না পড়িয়ে এ সব গ্রন্থ পড়ানো পণ্ডশ্রম মাত্র।”

মহাত্মা গাঁধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ শতকের গোড়ার দিকে ২৫-৩০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে গ্রাম গ্রামান্তর ঘুরে গরিব মানুষদের নিয়ে হাতেকলমে সমবায় সমিতি গড়ার কর্ণধারও ছিলেন হুইলার। অনুষ্ঠান না হলেও এমন মানুষ বিস্মৃত হ’ন না।

berhampur krishnanath college principal Rev. edward montego whiller
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy