অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
তিনি দিব্যি বেঁচে আছেন। রোজ দিনের মতো বৃহস্পতিবার সকালেও বাড়ির বাগানে একটু পায়চারি করেছেন। খুঁটিয়ে পড়েছেন খবরের কাগজ। তারপর দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষে ঘণ্টাখানেক ভাতঘুমও দিয়েছেন। খড়গ্রামের পারুলিয়া হরিচরণ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বছর চোদ্দো আগে অবসর নেওয়া পঞ্চানন মণ্ডলের হাতে এখন অঢেল সময়। বয়সের কারণে শরীরটা একটু বেগড়বাই করে বটে, তাই বলে সটান মৃত্যু?
হ্যাঁ, মৃত্যুই তো! বৃহস্পতিবার আচমকা সেই মৃত্যু সংবাদেই ভেঙে পড়েছিল পারুলিয়া হরিচরণ উচ্চ বিদ্যালয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় স্কুলের ইউনিট টেস্ট। তড়িঘড়ি পড়ুয়া ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ডেকে পালন করা হয় শোকসভা। কান্নাভেজা গলায় স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক আব্দুল আলিম বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক পঞ্চাননবাবু আর ইহলোকে নেই। আজ দুপুরেই তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আসুন, আমরা সকলে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করি।’’
গোটা স্কুল জুড়ে তখন পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। কেউ রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন। কোনও দুষ্টু ছাত্র আবার ফিসফিস করে পাশের বন্ধুকে জানতে চেয়েছে, ‘‘হ্যাঁ রে, পঞ্চাননবাবু কি খুব কড়া ধাতের ছিলেন?’’ স্কুলে আচমকা এমন শোকপালনের ঘটা দেখে অবাক হন এলাকার লোকজনও। কিন্তু তখনও বিষয়টি জানাজানি হয়নি।
গোল বাধল শুক্রবার। এ দিনও স্কুলে ইউনিট টেস্ট ছিল। কিন্তু সে সব বাতিল করে প্রার্থনার পরে ফের স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। কী ব্যাপার? ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক তাঁর সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের জানিয়ে দেন, পঞ্চাননবাবুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই ছুটি। ততক্ষণে খবর পৌঁছেছে এলাকার অভিভাবকদের কানে।
তাঁরা জানাচ্ছেন, বৃহস্পতিবার বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গিয়েছেন দক্ষিণ পারুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক হরপ্রসন্ন দত্ত। তাঁরা ভেবেছিলেন, সেই কারণেই হয়তো বৃহস্পতিবার স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শুক্রবার ফের ছুটি হওয়ায় তাঁরা জানতে পারেন, হরপ্রসন্নবাবু নয়, পঞ্চাননবাবুর মৃত্যু হয়েছে বলেই পরপর দু’দিন ছুটি দিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
এরপরেই ক্ষুব্ধ অভিভাবকেরা ভিড় করেন স্কুলে। তাঁদের অভিযোগ, এমনিতেই গরমের কারণে বেশ কিছু দিন স্কুল ছুটি ছিল। স্কুলে বুথ হওয়ায় ভোটের সময়েও স্কুল বন্ধ ছিল। তাছাড়াও কারণে –অকারণে প্রধানশিক্ষক মাঝেমধ্যেই স্কুলে ছুটি দিয়ে দেন।
অভিভাবক শঙ্খণ প্রামাণিক ও পরমেশ্বর দাসেরা বলছেন, ‘‘স্কুল কর্তৃপক্ষ যা করলেন তা হাস্যকর। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমাদেরই। বৃহস্পতিবারের ভুলের পুনরাবৃত্তি হল শুক্রবারেও! এটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এমন ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে সে ব্যাপারে আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। মাঝেমধ্যে ছুটি দিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আমরা শিক্ষা দফতরকে জানাব।’’
অভিভাবক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বৃহস্পতিবার স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষকের মৃত্যু সংবাদ শুনে স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হল। অথচ স্কুলের কেউ একবার ওই শিক্ষকের বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। সেখানে গেলেই তো আসল ঘটনা জানা যেত। তাঁদের অভিযোগ, ওই শিক্ষক স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন চোদ্দো বছর আগে। তাঁর মৃত্য সংবাদটা একবার যাচাই করার প্রয়োজনও মনে করেননি কেউ। এ সবই আসলে ছুটির বাহানা।
এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ পড়ুয়ারাও। তাঁদের কথায়, ‘‘কী কাণ্ড! যিনি দিব্যি বেঁচে আছেন, তাঁরই আত্মার শান্তির উদ্দেশে আমরা নীরবতা পালন করলাম। স্কুলে শোকসভাও হল! মাঝখান থেকে আমাদের দু’দিন নষ্ট হল। হল না ইউনিট টেস্টও।’’ পারুলিয়া হরিচরণ বিদ্যালয়ের এমন কথা শুনে রীতিমতো আঁতকে ওঠেন খড়গ্রামের বিডিও খুরশেদ আলম। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘বলছেন কী মশাই! শিক্ষক জীবিত। আর তাঁরই স্মৃতিতে স্কুল ছুটি! এমন কথা তো এই প্রথম শুনছি। এটা মারাত্মক ঘটনা। খোঁজ নিয়ে দেখে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে।”
জেলার অতিরিক্ত বিদ্যালয় পরিদর্শক (কান্দি) তাপসী দে বলেন, “স্কুলের কোনও প্রাক্তন শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মী মারা গেলে স্কুলে ছুটি দেওয়ার নিয়ম নেই। তবে স্থানীয় দাবিকে মর্যাদা দিয়ে এক বেলা স্কুল করার পরে ছুটি দেওয়া যেতে পারে। তবে সেটা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে স্কুল কর্তৃপক্ষের উপরে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তো ওই প্রাক্তন শিক্ষকের মৃত্যুই হয়নি। ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক কী করে এমন ভুল করলেন, বুঝতে পারছি না।’’
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল আলিম অবশ্য নিজের ভুল কবুল করে বলছেন, ‘‘ভুল তো ভুলই। নিজেরা একবার খোঁজ নিলে এই মারাত্মক ভুল এড়ানো যেত।” স্কুলের পরিচালন সমিতির সম্পাদক ইমামুল শেখ বলেন, ‘‘এমনটা ভুল আর কখনও হবে না।’’
আর যাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে এত কিছু সেই পঞ্চাননবাবু কী বলছেন?
শুক্রবার তাঁর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘‘এই তো আমি, দিব্যি বেঁচে আছি!’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘তবে সত্যিই যে দিন আমি মারা যাব, সে দিন স্কুল ছুটি না দিয়ে যদি অতিরিক্ত আরও একদিন স্কুলের পঠনপাঠন চলে তাহলে আমার আত্মা আরও শান্তি পাবে। কথায় কথায় এই ছুটি সংস্কৃতি এ বার বন্ধ হওয়া দরকার।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy