সাইকেলে সামিম বিশ্বাস। নিজস্ব চিত্র
ক্যানসার আক্রান্ত বাবা কাজ করার ক্ষমতা হারিয়েছেন বছর দুই আগে। চার সদস্যের পরিবারের পেট চালাতে তাই অর্থ উপার্জনে পথে নামতে হয়েছে বারো বছরের ছেলে সামিম বিশ্বাসকে। স্কুলছাত্র ওই বালক রোজ বিকালে বাবার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রোজার মাসে বিকেলে অনেকেই কিনে খান ওই বরফের ঝুরো আইসক্রিম।
শিশুশ্রম এই দেশে আইন-বিরুদ্ধ হলেও সামিম বিশ্বাসের দেখা মেলে আইসক্রিম হাতে। নিজের জন্য নয়, লকডাউনের মধ্যেও নিয়মিত আইসক্রিম ফেরি করতে রাস্তায় বেরোচ্ছে ছোট্ট সামিম। করোনা সংক্রমণের ভয়কে তুচ্ছ করে পথে পথে ঘুরছে সে। সব দিন ভাল রোজগার হয় না। আশপাশের পাড়ায় অল্প কিছু আইসক্রিম বিক্রি হয় রমজানের বিকেলে। দিনের শেষে ফিরে এসে ক্লান্ত শরীরে রাত কাটে নড়বড়ে পাটকাঠির বেড়া দেওয়া ঘরে।
এক দিকে, কালবৈশাখী ঝড়ের মরসুমে ঝড়ে ঘর পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক, অন্য দিকে, লকডাউনের কারণে চরম আর্থিক কষ্ট। তার উপরে রোজগারের মূল সামগ্রী আইসক্রিমের এখন সে ভাবে বিক্রি নেই।
থানারপাড়ার পিপুলখোলার ক্যানসার রোগী এনাফুল বিশ্বাসের সংসারে রোজগেরে বলতে তিনি একাই ছিলেন। স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, সামান্য জমিজিরেতটুকুও নেই এনাফুলের। দিনমজুরের কাজের পাশাপাশি মরসুমে আইসক্রিম বিক্রি, কখনও কখনও পাড়ায় পাড়ায় লোহা, টিন, প্লাস্টিক ভাঙাচোরা কিনতেন তিনি। এলাকার মানুষের সাহায্য নিয়ে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বছর দুয়েক আগে তাঁর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। দু’বার অস্ত্রোপচার, কেমো চলেছে। এখনও চিকিৎসার জন্য বেঙ্গালুরু যেতে হয়। প্রতি দিনের ওষুধ কিনতে কিনতে তাঁর সঞ্চয় সব শেষ।
বছর পঞ্চাশের এনাফুল বিশ্বাসের বর্তমানে স্ত্রী, এক ছেলে ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে সংসার। আগে কাজ করে সংসার চললেও দুই বছর আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে ঘরবন্দি। রোজার মাসে চরম সমস্যায় পড়েছে এনাফুল বিশ্বাস। এনাফুলের অভিযোগ, প্রায় পয়ষট্টি ঊর্ধ্ব তাঁর মা আয়েশা বেওয়া আজ পর্যন্ত সরকারি ভাতা পাননি। একটা সরকারি ঘরের জন্য বারবার স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও তা মেলেনি। বাড়িতে একশো দিনের কাজের একটি মাত্র জব কার্ড থাকলেও অসুস্থতার জন্য কাজ করতে পারেন না তিনি। মাস ছয়েক আগে অসুস্থ শরীরে কোনও রকমে আঠারো দিন একশো দিনের কাজ করে মাত্র ছ’শো টাকা পেয়েছেন।
তাঁর কথায়, “ছেলেটা নতিডাঙা অমিয় স্মৃতি বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুল থেকে মিড-ডে-মিলের আলু ও চাল এবং রেশনের চাল-আটা পেলেও অন্য কিছু কেনার টাকা নেই। তাই এখন স্কুল বন্ধ থাকায় বিকেলে পাড়ায় আইসক্রিম বিক্রি করে। বিশ-ত্রিশ টাকা ঘরে আনে সামিম।’’
তা দিয়ে সংসারের রোজকার আনাজ, তেল-নুনের খরচটা হয়ে যায়। এনাফুলের স্ত্রী আঞ্জুরা বিবি নিজেদের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলেন, “মাঠের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় ঘর। রাতে ঝড় উঠলে নড়বড়ে ঘর ভেঙে পড়ার ভয়ে বাড়ির কারও ঘুম হয় না। ভয়ে সিটিয়ে যায় ছোট্ট ছেলেটা। গুটিসুটি মেরে চৌকির নীচে ঢুকে পড়ে। ঘরের জন্য এলাকার পঞ্চায়েত প্রধান ও সদস্যকে বলেও কাজ হয়নি।” গমাখালির শিক্ষক রেবাউল মণ্ডল জানাচ্ছেন, লকডাউনে অত্যন্ত দুঃস্থ পরিবারটি আরও বেশি সমস্যায় পড়েছে। এখন কোনও রোজগার নেই। এলাকার সকলেই চান, অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়াক সরকার।
বালক সামিমের কোনও দাবি নেই। সে শুধু জানে, স্কুল যত দিন বন্ধ, আইসক্রিম ফেরি করে ঘরে ক’টা পয়সা আনতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy