Advertisement
০২ এপ্রিল ২০২৩

কোন থানার এক্তিয়ারে, অমোঘ সেই প্রশ্নের জটে রানাঘাটও

দিন পনেরো আগে দেশি মদের দোকান খোলা নিয়ে গোলমাল বেধেছিল বারাসতের নীলগঞ্জে। ভাঙচুর শুরু হয় রাস্তার পাশে পর পর দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতেও। ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে বারাসত থানা। কিন্তু সেখান থেকে কোনও পুলিশ সে দিন ঘটনাস্থলে যায়নি। কারণটা কী? ওই এলাকা দত্তপুকুর থানার এক্তিয়ারে পড়ে। এবং সেই থানা ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে!

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৫ ০৩:২৩
Share: Save:

দিন পনেরো আগে দেশি মদের দোকান খোলা নিয়ে গোলমাল বেধেছিল বারাসতের নীলগঞ্জে। ভাঙচুর শুরু হয় রাস্তার পাশে পর পর দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতেও। ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে বারাসত থানা। কিন্তু সেখান থেকে কোনও পুলিশ সে দিন ঘটনাস্থলে যায়নি। কারণটা কী? ওই এলাকা দত্তপুকুর থানার এক্তিয়ারে পড়ে। এবং সেই থানা ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে! খবর পেয়ে দত্তপুকুর থানার পুলিশ অকুস্থলে পৌঁছতে পৌঁছতে বহু টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়।

Advertisement

শুধু বারাসতই নয়, এলাকা ভাগাভাগি নিয়ে পুলিশের এমন দায়সারা মনোভাব দেখেছে শনিবারের রানাঘাটও। ডাকাতি হওয়া মিশনারি স্কুলটির কিলোমিটার খানেক দূরেই রানাঘাট থানা। কিন্তু স্কুলটি ১০ কিলোমিটার দূরের গাংনাপুর থানার এক্তিয়ারে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ খবর পেয়েও রানাঘাট থানা থেকে কোনও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়নি। গাংনাপুর থানা থেকে পুলিশ এসে পৌঁছেছে অনেক পরে।

বছর কয়েক আগের ঘটনা। লেক ও যাদবপুর থানার (তখনও যাদবপুর দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের আওতায়) সীমানায় এক দুর্ঘটনার তদন্তভার নিয়ে পুলিশি দায় চাপানোর বচসায় ঘণ্টা দুয়েক রাস্তাতেই পড়েছিলেন আহত ব্যক্তি। অবশেষে হাসপাতালে মারা যান তিনি। একই ঘটনা দেখা গিয়েছিল দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডেও। ধর্ষিতা তরুণী ও তাঁর আহত বন্ধু রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছেন। এলাকা কার, সেই প্রশ্নে নিজেদের মধ্যেই গোলমাল শুরু করেছিল রাজধানীর পুলিশ। এর ফলে নির্ভয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।

পুলিশের একাংশ বলছেন, কলকাতায় তো ফুটপাথ থেকে রাস্তায় পা দিলেই থানা বদলে যায়। ময়দান থানার বাড়িটাই সেই থানার অধীনে নয়। এটা পড়ে হেস্টিংস থানার আওতায়। দু’টি থানার দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার! হেয়ার স্ট্রিট থানাও তাই। ওই থানার এলাকা বৌবাজার থানার আওতায়। পুলিশকর্তারা বলছেন, ময়দান থানায় হামলার ঘটনা ঘটলে তার তদন্ত করবে হেস্টিংস থানা!

Advertisement

এমন সব পুলিশি ভূগোলেই বিপাকে পড়েন মানুষ। অনেক সময় আবার গোলমাল বাধে রেল পুলিশ আর সাধারণ পুলিশের এলাকা নিয়ে। হাওড়ার পুলিশ কর্তারা বলছেন, বাগনান থানা এবং বাগনান জিআরপি-র এলাকা নিয়ে গোলমাল প্রায় প্রবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। বছর চারেক আগে বাগনান স্টেশন সংলগ্ন একটি ঝিলে এক রেলকর্মীর দেহ ভাসতে দেখা যায়। কার এলাকায় দেহ, তা নিয়ে বিবাদে কেটে গিয়েছিল ১২ ঘণ্টা! হুগলিতে সিঙ্গুর থানা ও কামারকুণ্ডু জিআরপি-র দড়ি টানাটানিতে খোলা মাঠে টানা এক দিন পড়ে ছিল এক ব্যক্তির দেহ।

এমনই একটি ঘটনার কথা শুনিয়েছেন শিয়ালদহ জিআরপি-র এক প্রাক্তন কর্তাও। বছর কয়েক আগে নিউ ব্যারাকপুর ও মধ্যমগ্রাম স্টেশনের মাঝে নোয়াই খালে একটি দেহ ভাসছিল। ঘটনাস্থলে পৌঁছে এলাকা নিয়ে বিতর্ক শুরু করেন রেল পুলিশ ও ঘোলা থানার অফিসারেরা। রেল লাইন ও তার দু’পাশে নির্দিষ্ট দূরত্ব জিআরপি-র। কিন্তু রেল লাইনের ঠিক নীচেয় অবস্থিত খালটি কার? এ নিয়েই ঝগড়াঝাঁটি আর আইনের মারপ্যাঁচে বহু ক্ষণ মেতে ছিলেন পুলিশ অফিসারেরা!

ব্যতিক্রমও আছে। ২০০৩ সালের জলপাইগুড়ির দলগাঁও চা বাগানে ১৯ জনকে পিটিয়ে, কেটে এবং তার পর পুড়িয়ে খুন করেছিল ক্ষুব্ধ জনতা। চা বাগানের গা ঘেঁষে থাকা বীরপাড়া থানা সেই ঘটনার খবর পেয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু পুলিশি ভূগোলে দলগাঁও চা বাগান ২২ কিলোমিটার দূরে ফালাকাটা থানার এক্তিয়ারে। তবু সে দিন চুপ করে বসে থাকেননি বীরপাড়া থানার ওসি-সহ বাকি অফিসারেরা। ফালাকাটা থানা ও জেলা সদরে খবরটা দিয়েই দলগাঁও চা বাগানে ছুটেছিলেন বীরপাড়া থানার অফিসারেরা।

তবে এটা নেহাতই ব্যতিক্রম। কিছু দিন আগেই রবীন্দ্র সদনের কাছে ভরসন্ধ্যায় এক মহিলার মোবাইল ফোন চুরি যায়। তড়িঘড়ি তিনি পৌঁছেছিলেন ময়দান থানায়। কিন্তু ময়দান থানা অভিযোগ না নিয়ে পাঠায় হেস্টিংস থানায়। হেস্টিংস থানা মহিলাকে জানায়, চুরির এলাকাটা শেক্সপিয়র থানার অধীনে। সেখানকার পুলিশ সব শুনে ঘাড় নেড়ে বলেন, চুরির এলাকা ময়দান থানার আওতায়, যেখানে ওই মহিলা প্রথমে গিয়েছিলেন। “আমি চেঁচামেচি করায় শেক্সপিয়র থানার এক অফিসার অভিযোগ নেন, কিন্তু এটা যে তিনি দয়া করে করলেন, সেটা-ও মনে করিয়ে দেন”, বলছেন ওই মহিলা।

পুলিশ কর্তারা অবশ্য এমন অভিযোগ উঠলেই বলেন, যে কোনও থানাই অভিযোগ নিতে বাধ্য। তাঁর আওতাধীন এলাকায় না হলে সেই অভিযোগ সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দেওয়াটাই দস্তুর। কোনও ঘটনার ক্ষেত্রেই সবার আগে সাধারণ মানুষের সুবিধার কথা ভাবতে হবে পুলিশকে। অর্থাৎ, পুলিশি ভূগোল যা-ই হোক না কেন, মানুষ বিপদে পড়লে যে পুলিশকর্মী কাছাকাছি রয়েছেন, তাঁদেরই সবার আগে ঘটনাস্থলে আসতে হবে। পুলিশ কর্তাদের কথায়, রানাঘাটেও তাই হওয়া উচিত ছিল।

কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে পুলিশ কর্তাদের সেই বক্তব্যের মিল থাকে না। অনেকেই বলছেন, অভিযোগ তো দূর অস্ত, সাধারণ ব্যাগ খোওয়া যাওয়ার জেনারেল ডায়েরি করতে গেলেও এলাকা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করে পুলিশ।

থানার ভৌগোলিক সীমা নির্ধারণ করা নিয়ে পুলিশ অফিসারদের একটা বড় অংশ বলছেন, কোনও এলাকা থেকে তার থানার দূরত্ব চার কিলোমিটারের বেশি না হয়, সেটা মাথায় রাখতে হয়। থানা ভবনটি এলাকার কেন্দ্রে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু জেলাগুলিতে এই মান বজায় রাখা কার্যত অসম্ভব বলেই জানান পুলিশ কর্তারা। লালবাজার সূত্রের খবর, কলকাতা পুলিশের সংযোজিত এলাকাতেই এই মান বজায় রাখা যায়নি। কোনও এলাকার থানা এত বার ভেঙেছে যে এলাকা কার আওতায় তা জানতেই নাকাল বাসিন্দারা। তবে কলকাতা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, “এই এলাকার ঝামেলা ঠেকাতে এখন ঘটনা ঘটলেই রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড কিংবা স্পেশ্যাল টিম পাঠানো হয়। কোনও কোনও সময় একাধিক থানাও ঘটনাস্থলে গিয়ে অবস্থা আয়ত্তে আনে। পরে এলাকা নির্দিষ্ট করে একটি থানা তদন্ত শুরু করে।” পুলিশ কর্তারা যা-ই বলুন না কেন, রসিক নাগরিকেরা অবশ্য এই পুলিশি ভূগোল দেখে ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ সিনেমার সেই পরিচিত দৃশ্যের কথা বলেছেন। ডাঙার পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে গলা জলে দাঁড়িয়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘আমি এখন জল পুলিশের আন্ডারে!’

অনেকেই অবশ্য বলছেন, পুলিশি ভূগোলের এই রসিকতাটা কয়েক দশক আগের সিনেমাতেও প্রাসঙ্গিক ছিল। এখনও অবস্থাটা বদলায়নি। “কবে এই অবস্থাটা বদলাবে, সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে পুলিশ-প্রশাসনকেই,’’ বলছেন এক প্রাক্তন পুলিশকর্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.