পেরেকের উপর মাথা কুটছে হাতুড়ি। বাঁশকে শক্ত করে বাঁধছে পাটের দড়ি। বড় বড় কাঠের তক্তা আছড়ে পড়ছে মাটির উপর। আলতো করে কঞ্চি কাটছে চকচকে হাঁসুয়া। বিশ্ব সংসারে যে কত শব্দ আছে!
হেমন্তের ঝিম দুপুরে তেহট্টের অলিগলি থেকে উঠে আসা সেই সব শব্দ জানান দেয়, দুয়ারে পুজো। ভরা জলঙ্গির দু’পাড়ের ভিড় দেখে মাঝিও বুঝতে পারেন, পুজো এসে গেল। সাতসকালে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ, ঢাকের আওয়াজ, কাঁসির বোল জানিয়ে দেয়, আজ জগদ্ধাত্রী পুজো।
যে দিনটার জন্য পাক্কা একটা বছর অপেক্ষায় থাকে তেহট্ট। অপেক্ষায় থাকেন দূরদূরান্তে কাজে যাওয়া ছেলেরা। অপেক্ষায় থাকেন বাড়ির মহিলারাও। তেহট্ট জানে, এক উমা ফিরে গেলে মনখারাপ করতে নেই। কারণ, কয়েকদিন পরেই জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে সঙ্গেই বাপের বাড়ি ফিরবেন সহস্র উমা। এখন তেহট্ট জুড়ে তাই ঘরে ফেরার পালা। তেহট্ট বাসস্ট্যান্ড, ফেরিঘাট, জিৎপুর, হাউলিয়া কিংবা পিডব্লিউডি মোড়ে তাই ঘোর ব্যস্ততা, হইচই, দর-দাম, বিকিকিনি। কৃষ্ণনগর থেকে করিমপুরগামী বাসের কন্ডাক্টর তাই আশ্বস্ত করেন, ‘‘তেহট্ট পর্যন্ত দাঁড়িয়ে চলুন। ওখানেই বাস ফাঁকা হবে।’’
বাস থেকে নেমেই রেগে যান কোনও মহিলা, ‘‘এইটুকু তো পথ যাব। এত ভাড়া?’’ কপালের বিনবিনে ঘাম মুছে প্রৌঢ় টোটোচালক বলেন, ‘‘পুজোর সময় বলেই তো দু’টো টাকা বেশি চেয়েছি মা।’’ অমনি সেই মহিলার রাগ গলে জল, ‘‘আচ্ছা, চলুন।’’ পিছন থেকে আচমকা জাপটে ধরেন কেউ, ‘‘আরে সুবিমল তো? কত দিন পরে তোকে দেখলাম।’’ অভিমান ভুলে কোনও কিশোর হাসতে হাসতে হাত রাখে বন্ধুর কাঁধে, ‘‘আমাদের পাড়ার পুজো দেখতে আসিস কিন্তু।’’ এমনই টুকরো টুকরো অজস্র ছবি দিয়ে সেজে ওঠে তেহট্ট। জগদ্ধাত্রীর হাত ধরেই এই ক’দিন উধাও হয়ে যায় মনকেমনও।
অথচ আজ থেকে বিশ বছর আগেও তেহট্টে সে ভাবে কোনও জগদ্ধাত্রী পুজো হত না। জগদ্ধাত্রীর কথা উঠলেই লোকজনের মনে পড়ত চন্দননগর ও কৃষ্ণনগরের কথা। গত কয়েক বছরে জগদ্ধাত্রী পুজোর মানচিত্রে নিজের জায়গা করে নিয়েছে সীমান্ত ঘেঁষা এই জনপদ।
কী ভাবে শুরু হল পুজো?
তেহট্টের সেমনেস বয়েজ ক্লাবের সম্পাদক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘১৯৯৮ সালে আমাদের ক্লাবের কয়েক জন কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে গিয়েছিলেন। তার পরের বছরেই ওঁরা তেহট্টের জিৎপুর মোড়ে প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করে। সেই পুজো এখন তেহট্টের ‘বুড়িমা’ নামে পরিচিত।’’
আর তেহট্টের বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঘোষ হাসছেন, ‘‘২০০০ সালের বন্যা আমাদের দুর্গাপুজোও ভাসিয়ে দিয়েছিল। সে বার কোনও রকমে পুজো সেরেছিলেন তেহট্টের মানুষ। কিছু দিন পরে বানের জল নেমে গেল। দেখতে দেখতে চলে এল জগদ্ধাত্রী পুজো। সেই শুরু।’’
এ বারেও প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ৪০টি পুজো হচ্ছে। বাস্তবে সংখ্যাটা আরও বেশি। বেশিরভাগ পুজো এক দিনের হলেও সেমনেস বয়েজ, চাতরপাড়া ও বর্গিডাঙা পাড়ার পুজো চার দিনের। প্রতি বছর পুজো উদ্যোক্তারা চেষ্টা করেন নতুন কিছু করতে। কেউ সারাটা বছর ধরে থিম নিয়ে কাজ করেন, কেউ আবার মণ্ডপসজ্জায় তুলে ধরেন সমসাময়িক নানা ঘটনা। বির্সজনের শোভাযাত্রা দেখতেও ভিড় করেন বহু মানুষ।
তেহট্টের বৃদ্ধা ভবানী হালদার বলছেন, ‘‘দুর্গাপুজোর সময় তৈরি নাড়ু, মুড়কি সব শেষ। আবার নতুন করে তৈরি করেছি।” বহরমপুরের শিপ্রা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জগদ্ধাত্রী পুজোয় বাপের বাড়ি যেতেই হয়।’’
অপেক্ষায় থাকেন ব্যবসায়ীরাও। জগদ্ধাত্রীর হাত ধরে লক্ষ্মীলাভের সেরা সময়ও এটাই। আর তেহট্টের এই বিপুল ভিড় সামলাতে সতর্ক থাকতে হয় প্রশাসনকেও। নদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) তন্ময় সরকার বলছেন, ‘‘পুজো নির্বিঘ্নে পার করতে সব রকম ভাবে আমরা তৈরি। শব্দবাজি ও ডিজের দৌরাত্ম্য কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।’’ সব মিলিয়ে তেহট্ট এখন পুরোদস্তুর উৎসবের মেজাজে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy