প্রতীকী ছবি।
নাবালিকার বিয়ে দিলে শুধু মেয়ের বাবা-মা নন, সেই বিয়ের সঙ্গে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। ডেকরেটর, কেটারার, লজ মালিক, নাপিত কেউ বাদ যাবেন না। পাত পেড়ে নেমন্তন্ন খেতে আসা লোকেরাও ছাড় পাবেন না।
যাঁরা বিয়ে দেন, সেই পুরোহিত বা কাজিদেরও বার্তা দিতে চাইছেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা। ধর্মীয় বিধিকে প্রাধান্য দিয়ে যাতে দেশের আইন লঙ্ঘন না করা হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা শুরু হয়েছে।
নদিয়ার জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত বলেন, “আমরা পুরোহিত, ইমাম এবং অন্যদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করব। আইনটা আগে সকলকে পরিষ্কার করে জানানো দরকার।” মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘১৮ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়াটাই দেশের আইন। সেটাকেই আমরা মান্যতা দেব।’’
এ দেশে এককালে মেয়ে রজস্বলা হওয়ার আগেই বিয়ে দেওয়ার প্রথা ছিল হিন্দুদের মধ্যে, তাকে বলা হত ‘গৌরীদান’। শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সে প্রথা ক্রমশ বিলুপ্ত হলেও আঠারো বছরের কম বয়সে বিয়ে ‘স্বাভাবিক’ ছিল কয়েক দশক আগেও। ‘বালিকা বধূ’ শব্দটা নিছক ছায়াছবির নাম ছিল না। হিন্দু বিবাহ আইনে ১৫ বছর হলেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যেত। ১৯৭৮ সালে বাল্যবিবাহ রোধ আইন হওয়ার পরে তা বদলে ১৮ বছর করা হয়। ভারতীয় খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রেও বিয়ের বয়স একই।
তা সত্ত্বেও এখনও গাঁয়ে-গঞ্জে কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ রয়েই গিয়েছে। বিয়ের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক না হওয়ায় বহু ক্ষেত্রেই তা ধরা পড়ে না। মন্দিরে বা বাড়িতে এমন বিয়ে হচ্ছে আকছার। ‘মুসলিম পার্সোন্যাল ল’ বা শরিয়তি বিধিতে এখনও কম বয়সে বিয়ের সুযোগ রয়ে গিয়েছে। তারও সুযোগ নিচ্ছেন অনেক বাবা-মা। কম বয়সে মা হওয়ার বিপুল সংখ্যাই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। গত বছর নদিয়াতেই হাজার ছয়েক নাবালিকা মা হয়েছে। কম বয়সে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুর হারও উদ্বেগজনক।
এই পরিস্থিতিতে লাগাম টানতে ২০০৬ সালে কড়া বাল্যবিবাহ রোধ আইন আনা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে দু’বছর জেল এবং এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। নদিয়ার চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারপার্সন রিনা মুখোপাধ্যায় বলেন, “নাপিত, পুরোহিত ইত্যাদি তো বটেই, এমনকী যাঁরা নিমন্ত্রণ খেতে আসবেন তাঁদের বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ আছে।’’
মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া, নওদা, সাগরদিঘিতে এই চেষ্টা শুরু হয়েছে অনেক দিন আগেই। গ্রাম পঞ্চায়েত ধরে সচেতনতা শিবির হচ্ছে। স্কুলে কন্যাশ্রীযোদ্ধারা বিয়ে বন্ধে মরিয়া। ইমাম-মোয়াজ্জেমদের নিয়ে লাগাতার বৈঠক হচ্ছে। স্কুলে, পাড়ায়, কিসান মান্ডিতে হচ্ছে নাটক। প্রশাসনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। নাবালিকা মা চিহ্নিত করতে সতর্ক করা হয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীদেরও। সদ্য পুলিশ তৈরি করেছে ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ কমিটি, যার লক্ষ্যও সংগঠিত ভাবে নাবালিকা বিয়ে আটকানো। গ্রাম সংসদ স্তরে চাইল্ড প্রোটেকশন কমিটি গড়া হয়েছে।
কিন্তু শরিয়তের বিধানে যদি বিয়ে দেওয়া হয়? কৃষ্ণনগরের আইনজীবী শামসুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘‘শরিয়তি আইনে ১৫ বছরে মেয়ের বিয়ে হতে পারে। কিন্তু দেশের আইনে তা হওয়ার কথা নয়।’’ লালগোলার কাজি হেলালউদ্দিন বলেন, ‘‘মেয়ের বাবা-মাকে বুঝিয়ে রাজি করাতে না পারলে এক মাত্র তখনই কম বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়।’’ এক কদম এগিয়ে অরঙ্গাবাদের পঞ্চগ্রামের ইমাম আব্দুর রহমান বলেন, ‘‘শরিয়তে ১৫ বছরে বিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়নি। কিন্তু দেশের আইনে ১৮ বছরের কমে বিয়ে না দেওয়া বাধ্যতামূলক। তাই ১৮ বছর হলেই বিয়ে দেওয়া উচিত।’’ পশ্চিমবঙ্গ ইমাম-মোয়াজ্জিন কল্যাণ সমিতির নদিয়া জেলা সম্পাদক আসমত মণ্ডল বলেন, “নাবালিকা বিবাহের আইনের কথা আমরা সমস্ত সদস্যকে জানিয়ে দিয়েছি।”
যে সব মন্দিরে বিয়ে দেওয়ার চল আছে, সেগুলিতেও নজরদারি চালাবে পুলিশ। নব পুরোহিত সমাজের নদিয়া জেলা সম্পাদক শম্ভুনাথ মৌলিক বলেন, “আমরা সদস্যদের বলেছি, পাত্রপাত্রীর বার্থ সার্টিফিকেট দেখে বিয়ে দিতে হবে। যদি কেউ নাবালিকার বিয়ে দেন, তাঁর দায় কেউ নেবে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy