বেশ কয়েক শতক আগের কথা। অক্ষয় তৃতীয়া পার হতেই শুরু হয়ে যেত গঙ্গাপুজোর তোড়জোড়। জমিদারের মোসাহেবরা লেগে পড়তেন। চুপি-চুপি ভাল বাঈজী বা নর্তকীকে বায়না দিয়ে রাখতেন কেউ। কেউ আবার গোপনে চর পাঠিয়ে নবদ্বীপ,শান্তিপুর, রেউই, গুপ্তিপাড়া, তেহট্টের জমিদারদের প্রস্তুতির সুলুকসন্ধান নিতেন। যাতে দিনের দিন বাজিটা তিনিই মারতে পারেন।
বাতাসে ভেসে আসত নানা উড়ো খবর। তাই নিয়ে জমিদার বাড়ির বৈঠকখানা তোলপাড়। তার পর গঙ্গাপুজোর সাতসকালে গ্রামের ঘাটে ভিড়ত প্রকাণ্ড এক বজরা। ফুলে পাতায় সাজানো। সামনের খোলা জায়গা জরির কাজ করা রেশমি কাপড়ের চাঁদোয়ায় ঢাকা। সেখানে পাতা দুধসাদা ফরাস। লাল মখমলের পর্দা ঘেরা বজরার কামরায় কান পাতলে শোনা যায় টপ্পা-ঠুংরির টুকরো। অধৈর্য জমিদারবাবু সপারিষদ বজরায় উঠেই হাঁক দেন, “কই হে, টেনে চলো... বেলা যে গড়িয়ে এল।” অমনি ছপাছপ দাঁড়ের শব্দ তুলে বজরা দ্রুত মিলিয়ে যেত নদীর বুকে।
এ ভাবেই গঙ্গাপুজো আসত সেকালে। সুসজ্জিত বড় বড় নৌকায় গঙ্গার বুকে ইয়ার-দোস্ত নিয়ে হুল্লোর। গানবাজনা, খানাপিনায় একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য সে-কালের বিত্তবান মানুষেরা বেছে নিয়ে ছিলেন গঙ্গাপুজোর দিনটিকে। সড়ক পথে বাণিজ্যের তখনও তেমন প্রসার ঘটেনি। গঙ্গা নদী তখন দেশের প্রধান বাণিজ্যপথ। এ হেন গুরুত্বপূর্ণ জলপথে দিনভর সাড়ম্বর নৌবিহার করে নিজের বিত্ত ও প্রতিপত্তির সুনিপুণ বিজ্ঞাপন করতেন সে-কালের রাজা জমিদার, নব্যধনীরা। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত গঙ্গার দু’পারের সব বর্ধিষ্ণু জনপদেই ধুমধাম করে গঙ্গাপুজো হত সে সময়।
সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত কুমারনাথ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সগর রাজার বংশধর ভগীরথ সুরধুনী গঙ্গাকে মর্ত্যের বুকে এনে ছিলেন জ্যৈষ্ঠের এই শুক্লা দশমী তিথিতে। তাই এই দিনে গঙ্গা স্নানে সর্বপাপমুক্তি। স্মৃতিশাস্ত্রের নির্দেশ মেনে এই দিনে গঙ্গাপুজো হয়ে আসছে সুদূর অতীত থেকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার প্রয়োজনে নদীপুজোর ওই তিথিকে উৎসবের চেহারা দিয়েছে। নদী পুজো আমাদের দেশের বহুপ্রাচীন রীতি।’’
এ প্রসঙ্গে সমাজ-অর্থনীতির পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা পাহাড়ি নদীর গঙ্গার সমতলে অবতরণের কল্পকাহিনিকে বাদ দিলে চাষাবাদের প্রয়োজনে মানুষ প্রকৃতির বাধা উপেক্ষা করে খাল কেটে জল নিয়ে আসছে, এই তাৎপর্যটুকুই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আসন্ন বর্ষার ঠিক আগে দশহরার এই তিথিতে কৃষি ও বাণিজ্য উভয় ক্ষেত্রেই অপরিহার্য গঙ্গার মতো প্রধান নদীকে পুজো করার মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হয় নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আসলে প্রয়োজনের।
নদীর পাড় পরিষ্কার করা কিংবা নদীর ক্ষতিগ্রস্ত পাড়ের সংস্কার করা, আদতে হয়তো এ সবই ছিল গঙ্গাপুজোর মূল উদ্দেশ্য। নদীকে লালন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যাতে কোনও ভাবেই অবহেলিত না হয়, তাই একে ভক্তির মোড়কে উপস্থাপনা করা হয়েছিল। প্রথা মেনে এখনও তাই গঙ্গাপুজোর দিন গঙ্গার পাড় পরিষ্কার করার রেওয়াজ রয়েছে নবদ্বীপে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy