Advertisement
E-Paper

হাসপাতালে অসুস্থ স্ত্রী, বাইরে চলছে ইটবৃষ্টি

টোটোর অন্য যাত্রীরা ভয়ে নেমে পালিয়ে গেলেন। আমার বয়স হয়েছে। স্ত্রীও অসুস্থ। আমরা পালাব কী করে? নিরুপায় হয়ে বসে থাকলাম টোটোতেই। লিখছেন সুভাষ হালদারকিন্তু হাসপাতাল গেটের সামনে এসে দেখি সেখানেও বেশ ভিড়। কী ব্যাপার? টোটো চালক বললেন, ‘‘কাকু, আর মনে হয় যাওয়া হল না!’’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেন? টোটো চালক বলে চলেছেন, ‘‘কাকু, মনে হচ্ছে ভোটের ঝামেলা চলছে।’’

সুভাষ হালদার

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:০৮
ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

বাষট্টি বছরে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে গত কয়েক মাস আগে পঞ্চায়েত ভোটের সময় চোখের সামনে যা দেখলাম, যে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল তা জীবনে ভুলব না। তারিখটা ঠিক মনে নেই। স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম লালবাগ মহকুমা হাসপাতালে। হাসপাতালের টিকিট ঘরের সামনে গিয়ে দেখি বিরাট লাইন পড়েছে। আমিও টিকিট নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে অবশেষে স্ত্রীকে নিয়ে গেলাম ডাক্তারবাবুর কাছে। কিছু ওষুধ তিনি হাসপাতাল থেকেই দিলেন। আর তিনটে ওষুধ বাইরে থেকে কিনে নিতে বললেন। একটা টোটো ভাড়া করে হাসপাতাল থেকে বেরোচ্ছি। সাড়ে বারোটার লালগোলা প্যাসেঞ্জার ট্রেন। ভাবলাম, ট্রেনটা পেয়ে যাব। এই আশাতেই টোটো চালককে একটু তাড়াতাড়ি চালাতে বললাম।

কিন্তু হাসপাতাল গেটের সামনে এসে দেখি সেখানেও বেশ ভিড়। কী ব্যাপার? টোটো চালক বললেন, ‘‘কাকু, আর মনে হয় যাওয়া হল না!’’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেন? টোটো চালক বলে চলেছেন, ‘‘কাকু, মনে হচ্ছে ভোটের ঝামেলা চলছে।’’ তার পরেই দেখি, সামনের ভিড় ভেঙে সব্বাই ছুটছে। সবার মুখে একটাই কথা, ‘শিগ্গির পালাও।’ মনে হল, যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। একটু পরেই দেখি, কিছু লোক হাতে বাঁশ-লাঠি নিয়ে ধেয়ে আসছে। টোটোতে স্ত্রীকে নিয়ে বুঝতে পারছি না, কী করব? স্ত্রী ভয়ে আমার হাতটা ধরলেন। টোটোর অন্য যাত্রীরা ভয়ে নেমে পালিয়ে গেলেন। আমার বয়স হয়েছে। স্ত্রীও অসুস্থ। আমরা পালাব কী করে? নিরুপায় হয়ে বসে থাকলাম টোটোতেই। একটু পরে টোটো চালককেই অনুরোধ করলাম, ‘‘ভাই, হাসপাতালেই নিয়ে চলো। সেটা তবুও নিরাপদ জায়গা।’’

হাসপাতালে ফিরে একটি গাছের নিচে জায়গায় স্ত্রীকে নিয়ে বসলাম। সেখান থেকেও শুনতে পাচ্ছি, বাইরের লোকের আওয়াজ, নানা রকম স্লোগান। এ দিকে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, ওষুধটা তাড়াতাড়ি খাওয়ানোর কথা। সেই মতো আমি একা স্ত্রীকে বসিয়ে বেরোলাম ওষুধ আনতে। কিন্তু হাসপাতালের গেট থেকে বেরোতেই আমি যা দেখলাম, তাতে মনে হল আমি যেন কোনও যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক দলের সমর্থকেরা। কারও হাতে দলের পতাকা। কারও হাতে বাঁশ, লাঠি, উইকেট। এক দল পতাকা উঁচু করে স্লোগান দিতেই অন্য দলের লোকজন বাঁশ-লাঠি উঁচিয়ে রে রে করে তেড়ে এল। রাস্তা দু’দিকেই বন্ধ। সামনে বাসস্ট্যান্ডের ওষুধের দোকান। কিন্তু দোকানের লোকজন ভয়ে শাটার নামিয়ে দিলেন। পুলিশ দু’দলের লোকজনকে সামলানোর চেষ্টা করেছে। সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা ছবি তুলছে। আচমকা বাসস্ট্যান্ডের পিছন থেকে পর পর তিনটে বোমার আওয়াজ পেলাম। তার পরে শুরু হল দু’দলের ঢিল ছোড়া। আমার মতো বহু মানুষ তখন ভয়ে কাঁপছে।

আমি কোনও রকমে হাসপাতাল গেটের পাশে থাকা একটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ি। এ দিকে, স্ত্রীর জন্য চিন্তা হচ্ছে। সে তো একা বসে আছে হাসপাতালে, গাছের নীচে। এরপরে আর কিছু না ভেবে ফের হাঁটা দিলাম সেখানেই। স্ত্রী আমাকে দেখেই জানতে চাইল, ‘‘কী গো, ওষুধ আনলে?’’ আমি বললাম, ‘‘সে আর পেলাম কই! বাইরে যা চলছে।’’ বেশ কিছুক্ষণ পরে সব শান্ত হল। তার পরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কোনও রকমে ট্রেন ধরে জিয়াগঞ্জ আসি। তার পরে স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনে রাস্তাতেই ওকে ওষুধ খাইয়ে বাড়ি ফিরি। সেই দিনটা যে কী ভাবে কেটেছে তা আমরাই জানি। বয়সও বাড়ছে। ভয়ও বাড়ছে।

জিয়াগঞ্জের বাসিন্দা

Vote Violence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy