তিনি মারা গিয়েছেন প্রায় চার দশক আগে, ১৯৭০ সালে। অথচ সেই তিনিই ২০১৫ সালে জমি রেজিস্ট্রি করিয়ে গেলেন!
এই ঘটনা শান্তিপুরের সুত্রাগড় এলাকার। অভিযোগ, ২০১৭ সালে শান্তিপুরের জহর সাহা জানতে পারেন যে সুত্রাগড়ের তাঁদের একটি ন’বিঘা আমবাগানের এক দিকে পাঁচ কাঠার মতো জায়গা ঘিরে নেওয়া হচ্ছে। যাঁরা ঘিরছেন তাঁদের দাবি, এই জমি তাঁদের। জমিটি তাঁরা কিনেছেন। কিন্তু বিক্রি করল কে? জহরের দাবি, “ওঁদের কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে, ওই জমি ২০১৫ সালে বিক্রি করেছেন আমার দাদু অমূল্যচরণ সাহা, যিনি মারা গিয়েছেন ১৯৭০ সালে। তা হলে কি আমার দাদুর ভূত এসে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে গেলেন?”
উত্তরটা জানা নেই কারও। যেমন জানা নেই কী ভাবে এক জন মারা যাওয়ার পরে তাঁর জমি ওয়ারিশ সূত্রে একটা ক্লাবের নামে হয়ে যায়। ঘটনা তাহেরপুরের বাদকুল্লার। মৃতের স্ত্রী-সন্তান ছিলেন না, আত্মীয়-স্বজন ছিলেন। ওয়ারিশ সূত্রে জমি নথিভুক্ত হওয়ার কথা তাঁদের নামে, কিন্তু বাস্তবে একটা ক্লাবের নামে নথিভুক্ত হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় দরবার করেও লাভ হয়নি।
কিন্তু কী ভাবে হচ্ছে এ সব?
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এর পিছনে রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী চক্র। সেই চক্রে ছোট-বড় নেতা থেকে শুরু করে জড়িয়ে রয়েছেন রেজিস্ট্রি এবং ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক শ্রেণির কর্মীও। সকলের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটা করে দালালেরা। জহর সাহার অভিযোগ, “এই জালিয়াতিগুলির পিছনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির কিছু কর্মীও জড়িত। তা না হলে ঘটছে কী ভাবে? অভিযোগ জানানোর পরও যখন কাজ হয় না, তখন তো তা ধরে নিতেই হবে।”
বিএলএলআরও দফতরের একটি সূত্রের দাবি, জালিয়াতি হচ্ছে একাধিক উপায়ে। প্রথমত, সরাসরি জাল দলিল তৈরি করা হচ্ছে। তা নাকি এত নিখুঁত ভাবে হচ্ছে যে রেভিনিউ অফিসারেরা তা ধরতে পারছেন না। জাল দলিল দেখেই তাঁরা কম্পিউটারে ‘ই-ভূচিত্র’ সফটওয়্যারে নথিভুক্ত করে দিচ্ছেন। যদিও তা মানতে নারাজ ভুক্তভোগীরা। তাঁদের বক্তব্য, এই রেভিনিউ অফিসারেরা অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ। নথি জাল হলে কোনও ভাবেই তাঁদের নজর এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। তা হলে? তাঁদের অভিযোগ, এই জায়গাতেই খেলা দেখাচ্ছে শক্তিশালী চক্র। খোলা চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নজরে পড়া সত্ত্বেও বদলে যাচ্ছে নথি। কখনও আবার সরকারি ভাবেই জাল নথিপত্র দিয়ে তৈরি হচ্ছে দলিল। সেই দলিল ব্যবহার করেই ‘ই-ভূচিত্রে’ বদলে দেওয়া হচ্ছে জমির মালিকের নাম। অনেক ক্ষেত্রে আবার জাল বা আসল কোনও দলিল ছাড়াই নথিতে নাম বদলে দেওয়া হচ্ছে।
ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক শ্রেণির কর্মীই বলছেন, বছর কয়েক আগে চালু হয়েছে ‘ই-ভূচিত্র’ নামে একটি সফটওয়্যারের ব্যবহার। তাতে রেভিনিউ অফিসারদের নথিতে রদবদল করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের আলাদা পাসওয়ার্ড আছে। সেই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে তাঁরা কম্পিউটারে সেই সফটওয়্যার খুলতে পারেন। অভিযোগ, ঠিক এই জায়গায় এসেই নথিতে বদলে যাচ্ছে জমির মালিকের নাম। সেই সঙ্গে এই কাজের জন্য নির্দিষ্ট ফর্মেও তা লিখে রাখা হচ্ছে। এর দায় এড়াতে পারেন না কোনও ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিকই। কারণ, সবটা দেখার দায়িত্ব তাঁরই। যদিও তাঁদের দাবি, প্রতিদিন এত নথি পরিবর্তন হচ্ছে যে তাঁদের পক্ষে সবটা দেখে নেওয়া সম্ভব হয় না। আর তারই ফাঁকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জালিয়াতি হচ্ছে।
জেলাশাসক সুমিত গুপ্তের বক্তব্য, “আমরা বিভিন্ন বৈঠকে বারবার সতর্ক করছি যাতে কোনও কর্মী এ রকম ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকেন। প্রমাণ পেলে কঠোর আইনি পদক্ষেপ করা হবে।” ভুক্তভোগীরা অবশ্য দাবি করছেন, গোটা বিষয়টাই ‘ওপেন সিক্রেট’। জেলার সর্বস্তরের কর্তারাই তা জানেন। কিন্তু চক্র এত শক্তিশালী এবং এদের শিকড় এতটাই গভীরে যে সব জেনেও কেউই তেমন কিছু করতে পারছেন না।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy