Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নিভন্ত চুল্লিতেও পাক খায় বনিদের যৌথস্বপ্ন

ফিরোজের চোখের সামনে অসংখ্য দৃশ্য ভেসে উঠল। কত মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। সকাল-বিকেলে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে গৃহশিক্ষকের কাছে যাচ্ছে পড়তে।

সায়ন্তনী এখনও পড়াশোনা করছে। এ বছর সে উচ্চমাধ্যমিক দেবে। তার পর অবশ্য সেও জানে না, তার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে, কলেজ নাকি ছাদনাতলা! প্রতীকী ছবি।

সায়ন্তনী এখনও পড়াশোনা করছে। এ বছর সে উচ্চমাধ্যমিক দেবে। তার পর অবশ্য সেও জানে না, তার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে, কলেজ নাকি ছাদনাতলা! প্রতীকী ছবি।

শুভাশিস সৈয়দ
শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৯ ০২:৩০
Share: Save:

বার দু’য়েক গর্জে উঠে এক্কেবারে চুপ মেরে গেল মোটরবাইকটা। ফিরোজ ইসলাম স্পষ্ট বুঝতে পারলেন তাঁর বাহনের জ্বালানি শেষ। আর এগোবে না। ঠিক সেই সময় একটি ছেলে এগিয়ে এল, ‘‘ভাল আছেন স্যর?’’

ম্লান হেসে ফিরোজ বললেন, ‘‘ভাল ছিলাম। এখন নেই। তোমার সাইকেলটা একটু দেবে? পাম্প থেকে পেট্রল নিয়ে আসব।’’

ছেলেটির নাম উজ্জ্বল সরকার। তার বোন সায়ন্তনীকে পড়াতেন ফিরোজ।

—আপনার কাছে তেল নিয়ে আসার জায়গা আছে?

—নাহ্!

—আমি বাড়ি থেকে নিয়ে আসছি। আপনি একটু দাঁড়ান।

উজ্জ্বল বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন সায়ন্তনীর মা। পিছু পিছু সায়ন্তনী, ‘স্যর কেমন আছেন? ভেতরে আসুন।’

বারান্দায় একটা চেয়ারে বসলেন ফিরোজ। সাইকেল ও জেরিকেন নিয়ে উজ্জ্বল গেল পেট্রল পাম্পে।

ফিরোজকে চা-বিস্কুট এনে দিলেন সায়ন্তনীর মা। বছর কয়েক আগে ফিরোজের কাছে পড়ত রাখী, বৃষ্টি, বনি, রিতা, সায়ন্তনীরা।

—আচ্ছা সায়ন্তনী, তোর সঙ্গে যারা পড়ত তাদের খবর কী?

—উচ্চমাধ্যমিকের পরে বৃষ্টির কলেজে ভর্তি হওয়ার সব ঠিক। কিন্তু ওর বাবা কলেজে ভর্তি করতে রাজি হল না। পরে ওর বিয়ে হয়ে যায়।

—বাকিরা?

—বনি মারা গিয়েছে স্যর। উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার আগেই বাবা-মা বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করে। কিন্তু বনি চেয়েছিল পড়াশোনা করতে। ওকে ঘরবন্দি করে রেখে দিয়েছিল। বাড়িতে গিয়েছিলাম এক দিন ওর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু ওর মা দেখা করতে দেয়নি। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে আসি। পরের দিন সকালে খবর পাই, বনি বিষ খেয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও তাকে আর বাঁচানো যায়নি।

ফিরোজের মনটা খারাপ হয়ে যায়। উজ্জ্বল ইতিমধ্যে পেট্রল নিয়ে বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফেরেন ফিরোজও। ফিরোজ বাড়িতে বসে সাতপাঁচ ভাবছিল। মোবাইল জানান দেয়, হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ এল। ফিরোজ দেখলেন সেখানে লেখা রয়েছে, মূলত বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কারণে বেশিরভাগ মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকের পরে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে...।

ফিরোজের চোখের সামনে অসংখ্য দৃশ্য ভেসে উঠল। কত মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। সকাল-বিকেলে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে গৃহশিক্ষকের কাছে যাচ্ছে পড়তে। কিন্তু যেই মাধ্যমিকের গণ্ডী পার হল, অমনি তাদের সংখ্যা কমতে থাকল। উচ্চমাধ্যমিকের পরে দু’-চার জনকে দেখতে পাওয়া যায়, যারা কলেজে যাচ্ছে।

ফিরোজ একটি মেয়েকে পড়াত। সে পড়াশোনায় ভাল ছিল। কিন্তু এক দিন দেখল সে পিছিয়ে পড়ছে। পরে জানতে পারে, বাড়িতে তার মা অসুস্থ। চলাফেরা করতে পারেন না। বাড়ির যাবতীয় কাজ তাকেই করতে হয়। কিন্তু পড়াশোনা করতে ভালবাসে। সারা দিনের কাজের ফাঁকেও পড়াশোনার চেষ্টা করে। কিন্তু এই মেয়েগুলোর জীবনচর্যা খুব অল্প সময়ের মধ্যে পাল্টে গিয়ে অন্য জীবনে ঢুকে পড়ছে। শুরু হয়ে যাচ্ছে অন্য এক জীবনের লড়াই!

যে সব মেয়েরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে, বাকিদের সঙ্গে কয়েক লক্ষ যোজন দূরত্বের ব্যবধান তৈরি হয়ে যাচ্ছে তাদের। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না তাদের।

তবে সায়ন্তনী এখনও পড়াশোনা করছে। এ বছর সে উচ্চমাধ্যমিক দেবে। তার পর অবশ্য সেও জানে না, তার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে, কলেজ নাকি ছাদনাতলা!

ফিরোজের নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। তিনি ভাবতে থাকেন, এর কি কোনও প্রতিকার নেই? নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে আত্মজদের স্বপ্ন খুন করে চলেছেন অভিভাবকেরা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Child Marriage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE