Advertisement
E-Paper

কাকতাড়ুয়াকে গুলি, পাখি তাড়াচ্ছে প্লাস্টিক

বিঘের পর বিঘে ঢুঁড়ে ওদের এখন দেখা মেলাই ভার। যে দু’একটি টিকে রয়েছে তাদের দেখে পাখিরা ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টে তাদেরই যেন ভেংচি কাটে। অথচ এক কালে কী কদরই না ছিল! সীমান্তে বিএসএফ আর লাগোয়া খেতে তারাই তো ছিল অতন্দ্র প্রহরী। কাকতাড়ুয়ার দাপটে ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারত না কাকপক্ষী।

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৪ ০০:০৪
 কাকতাড়ুয়ার জায়গা নিয়েছে ক্যারিব্যাগ। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক।

কাকতাড়ুয়ার জায়গা নিয়েছে ক্যারিব্যাগ। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক।

বিঘের পর বিঘে ঢুঁড়ে ওদের এখন দেখা মেলাই ভার।

যে দু’একটি টিকে রয়েছে তাদের দেখে পাখিরা ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টে তাদেরই যেন ভেংচি কাটে। অথচ এক কালে কী কদরই না ছিল! সীমান্তে বিএসএফ আর লাগোয়া খেতে তারাই তো ছিল অতন্দ্র প্রহরী। কাকতাড়ুয়ার দাপটে ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারত না কাকপক্ষী।

মাটির হাঁড়িতে চুন দিয়ে কাঁচা হাতে চোখ-নাক এঁকে, একটা বাতিল জামা গায়ে জড়িয়ে জমিতে দাঁড় করিয়ে দিতে পারলেই চাষির ঘুমের গ্যারান্টি। নিশ্চিন্ত জমিমালিকেরাও। সেই সব অতন্দ্র কাকতাড়ুয়াদের দিন গিয়েছে। তার জায়গা নিয়েছে ক্যারিব্যাগ কিংবা মিহি সুতোর জাল। সৌজন্যে, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ওরফে বিএসএফ।

বছর কয়েক আগেও নদিয়ার সীমান্ত লাগোয়া খেতগুলোতে হামেশাই দেখা মিলত কাকতাড়ুয়ার। তাদের একচেটিয়া রাজত্ব ছিল হোগলবেড়িয়ার কাছারিপাড়া, মধুগাড়ি, চামনার মতো সীমান্ত-ঘেঁষা গ্রামগুলোতে। ওই সব এলাকায় প্রচুর সব্জি চাষ হয়। আর সব্জির জমি, বিশেষ করে বেগুন খেতে কাকতাড়ুয়ার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য।

তা হলে হঠাৎ ঘটলটা কী?

কাছারিপাড়ার বাসিন্দা তথা করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ শঙ্কর মণ্ডল জানান, “বছর কয়েক আগে রাতদুপুরে হঠাৎ বিএসএফের চিৎকার আর গুলির আওয়াজে আমরা ভেবেছিলাম, বোধহয় ফের সীমান্তে অঘটন ঘটল। তখন বেশ চোরাপাচার চলত। দল বেঁধে গিয়ে দেখি, খেতে চিতপটাং হয়ে পড়ে বেচারা কাকতাড়ুয়া। মাটির হাড়িটা গুলিতে ঝাঁঝরা। রাতের অন্ধকারে কাকতাড়ুয়াকে পাচারকারী ভেবেই বোধহয় গুলি চালিয়ে বসেছিল বিএসএফ।” তারপর থেকে কাছারিপাড়া ও লাগোয়া এলাকায় বিএসএফের নির্দেশ ছিল ‘অর কুছ কিজিয়ে। লেকিন খেতি মে ইয়ে সব নেহি চলেগা।’

স্থানীয় মধুগাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সদস্য মফিজুল মণ্ডলের কথায়, “বিএসএফের নির্দেশে পরের দিনই জমি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় কাকতাড়ুয়া। বিএসএফের সেই ব্যাটালিয়ন চলে গিয়েছে। কিন্তু নিয়মটা আজও বহাল রয়েছে। সাহস করে জমিতে আর কেউ কাকতাড়ুয়া রাখেন না। বরং পাখির উপদ্রব থেকে ফসল বাঁচাতে নতুন জিনিসের আমদানি হয়েছে।” তিনি জানান, এক সময় বাতিল অডিও ক্যাসেটের ফিতে জমির উপরে টাঙিয়ে রাখা হত। হাওয়ায় সেগুলো নড়লে ভয়ে পাখি আসত না। এখন অবশ্য সে পাটও উঠে গিয়েছে। নতুন সংযোজন হয়েছে ক্যারিব্যাগ।

নদিয়ার ওই সীমান্তে এখন রয়েছে বিএসএফের ৯১ নম্বর ব্যাটেলিয়ন। তাদের এক আধিকারিকের বাখ্যা, “নিরাপত্তার স্বার্থে কখনও-কখনও স্থানীয় ভাবে কিছু ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গ্রামের মানুষকে সতর্কও করা হয়। যেমন, সীমান্ত লাগোয়া মাঠে কলা কিংবা পাটের মতো লম্বা ফসল লাগাতে আমরা নিষেধ করি। তাতে নজরদারিতে অসুবিধা হয়। তেমনই কোনও কারণে আমাদের আগের কোনও ব্যাটালিয়ন হয়তো জমিতে কাকতাড়ুয়া রাখতে নিষেধ করেছিল। দিনে সমস্যা না হলেও রাতে নাইট ভিশন ক্যামেরায় কাকতাড়ুয়াকে হঠাৎ মানুষ বলে ভুল হওয়াটা কিন্তু মোটেই অস্বাভাবিক নয়।”

চাষিরাও আর নতুন করে ঝক্কিতে যেতে চাইছেন না। চামনার এক চাষির কথায়, “কী দরকার বাবা, ফের কাকতাড়ুয়া এনে বিপদ বাড়ানোর? কথায় আছে, সীমান্তে বাস, সমস্যা বারোমাস। বিএসএফ আবার কখন ফস করে কী বলে বসে! তার চেয়ে ক্যারিব্যাগ ঢের ভাল।” তিনি জানান, এটা-ওটা কিনে বাড়িতে অনেক ক্যারিব্যাগ জমেই যায়। সেগুলো দড়িতে বেঁধে কিংবা পাটকাঠিতে আটকে জমির উপর ঝুলিয়ে দিলেই হল। কেউ-কেউ আবার একধাপ এগিয়ে বেগুন কিংবা অন্য সব্জির জমি মিহি সুতোর জালেও মুড়ে দিচ্ছেন।

তেহট্ট মহকুমার সহকারি কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) গৌতম সেনগুপ্ত বলেন, “শুধু ওই সীমান্ত এলাকাতেই নয়, মহকুমা জুড়েই কাকতাড়ুয়ার সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। অনেকেই ক্যারিব্যাগ কিংবা সুতোর জাল ব্যবহার করছেন।”

দমকা বাতাসে পদ্মার কোল ঘেঁষা বেগুন খেতে সশব্দে উড়ছে সার সার ক্যারিব্যাগ। কাকতাড়ুয়ারা তা হলে নীরবে হারিয়েই গেল?

gourav biswas bird plastic
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy