Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

কালীপুজোয় মনে পড়ে হারানো আতসবাজি

উঠোনের দুদিকে দু’টো বাঁশের খঁুটিতে টাঙানো সরু তার। লোহার সেই তারের একপ্রান্তে ঝুলছে অনেকটা দেশলাই বাক্সের মতো দেখতে নিতান্ত নিরীহ একটি বস্তু। বাক্সের একদিক থেকে বেরিয়ে থাকা সলতের মুখে আগুন দিলেই হল। সেই বাক্স তখন রঙিন আলোর ফুলকি ছড়িয়ে ওই তারের মধ্যে দিয়ে প্রবল গতিতে ছুটতে শুরু করেছে। খুঁটির একপ্রান্তে পৌঁছেই আবার ছুট। এবার অন্যপ্রান্তে। দিক বদলের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে তার ফুলকির রঙও। বেশ কয়েকবার এমন ছোটাছুটির পর তার শান্ত হওয়ার পালা।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৩৪
Share: Save:

উঠোনের দুদিকে দু’টো বাঁশের খঁুটিতে টাঙানো সরু তার। লোহার সেই তারের একপ্রান্তে ঝুলছে অনেকটা দেশলাই বাক্সের মতো দেখতে নিতান্ত নিরীহ একটি বস্তু। বাক্সের একদিক থেকে বেরিয়ে থাকা সলতের মুখে আগুন দিলেই হল। সেই বাক্স তখন রঙিন আলোর ফুলকি ছড়িয়ে ওই তারের মধ্যে দিয়ে প্রবল গতিতে ছুটতে শুরু করেছে। খুঁটির একপ্রান্তে পৌঁছেই আবার ছুট। এবার অন্যপ্রান্তে। দিক বদলের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে তার ফুলকির রঙও। বেশ কয়েকবার এমন ছোটাছুটির পর তার শান্ত হওয়ার পালা।

এক সময়ে খুব জনপ্রিয় “ট্রেনবাজির” দৌড় অবশ্য থেমে গিয়েছে অনেকদিন। ৬৫ পার করা অশোক রায় বলছিলেন, “ছোটবেলায় দীপাবলির রাতে একটু সম্পন্ন গৃহস্থের অন্ধকার উঠোনের সামনে বা বাড়ির ছাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম ট্রেনবাজি দেখার জন্য। শুধু কি তাই, অন্ধকার উঠোনে খঁুটির দু’প্রান্তে ভিড় করা কুচো কাঁচারা দু’দলে ভাগ হয়ে গিয়ে ঝগড়া করত, কাদের খঁুটিতে ‘ট্রেন’ এসে বেশিক্ষণ দাঁড়ালো তা নিয়ে।”

নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব শোনাচ্ছিলেন বাজি তৈরির ওস্তাদ গৌর মালাকরের হাউইবাজির এর গল্প। সে কালে নবদ্বীপে মহাপ্রভুর জন্মতিথিতে অর্থাত্‌ দোল পূর্ণিমার রাতে হাউই ফাটানো হত ‘গাছ’। শান্তিবাবুর ব্যাখ্যা করে বলেন, “একটা লম্বা বাঁশের আপাদমস্তক নানা রকমের বাজি দিয়ে সাজানো হত। তাতে শব্দবাজি, চরকি, হাউই সবই থাকত। যিনি তৈরি করতেন তিনি একেবারে নীচে কোনও একটি নির্দিষ্ট বাজিতে আগুন দিয়ে সরে যেতেন। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিক ভাবে একের পর এক রকমারি বাজি ফাটতে থাকত। বিভিন্ন উত্‌সবে এই গাছের উচ্চতা এবং স্থায়ীত্ব নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত।” হাউই আকাশে গিয়ে তৈরি করত ফুল, পরী, দেবদেবী।

বেলুড় মঠের যে কোনও উত্‌সবে গৌর মালাকারের হাউই নিয়মিত যেত। অন্ধকার গঙ্গার বুকে নৌকা থেকে একের পর এক হাউই উড়েছে, আর আকাশে গিয়ে তা থেকে বেরিয়ে এসেছে রামকৃষ্ণ, সারদাদেবী, স্বামীজির রঙিন প্রতিকৃতি। সেসব বাজি কবেই হারিয়ে গেছে। তবু আজও শান্তিবাবুর মতো প্রবীণ মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছেন গৌর মালাকার আর তাঁর সৃষ্টির আলো।

মিলিয়ে গিয়েছে আছাড়ে পটকা, চটপটি, সিটি বা ছঁুচোবাজিরা। এক আনা দামে পাওয়া যেত চটপটি। ওষুধের পাতা মতো দেখতে, একটা করে ছঁড়িয়ে নিয়ে দেওয়াল বা মেঝেতে আঙুলে ঘষে ফাটানো হত চটপটি। উত্‌সব শেষের পরও থেকে যেত আঙুলের ক্ষত। বড় চাবির গর্তের মধ্যে বারুদ ভরে তার ওপর পেরেক ঢুকিয়ে মাটিতে আছাড় মেরে ফাটানোর আছাড়ে পটকা ছিল সব চেয়ে সস্তার বাজি। কখনও আবার একটু বড় মাপের নাটবল্টুর ফাঁকে বারুদ ঢুকিয়েও ‘আছাড়ে পটকা’ তৈরি করা হত।

তবে সেকালে সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল ছঁুচোবাজি। আগুন ছঁুইয়ে দিলেই একটা অদ্ভুত শব্দে যে কোন দিকে ছুটে যেত ছুঁচোবাজি। কত লোকের অনিষ্টও করেছে। গাঁয়ে গঞ্জে কালীপুজোর রাতে ধানের গোলা, খড়ের চালা যে কত পুড়িয়েছে ছুঁচোবাজি তার ইয়ত্তা নেই। প্রবীণ আইনজীবী দিলীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সে কালে দুষ্টু ছেলেদের খুব পছন্দের ছিল ওই ছুঁচোবাজি। রাংতায় মোড়া একদিকে সরু ছুঁচো বাজির চলন ছিল অনেকটা ছুটে পালান ছুঁচোর মত। তবে সে যে কোন দিকে ছুটবে তা বোঝে কার সাধ্য! এই চলন ঘিরে যাবতীয় মজা এবং দুর্ঘটনার সূত্রপাত। ছুঁচোবাজি ফেটেছে অথচ কোনও গোলমাল হয়নি এমন ঘটনা বিরল। তাই ষাটের দশকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ছুঁচোবাজিকে।

আর ছিল কান ফাটানো শব্দে আকাশে ছুটে যাওয়া সিটিবাজি। সিটিবাজি নিয়েও আজকের প্রবীণদের নস্টালজিয়ার শেষ নেই। কৌটোর মত দেখতে সিটিবাজির যাবতীয় মজা ছিল তীক্ষ্ম শব্দে। অন্ধকার আকাশে যত দূরে যেত শব্দ যেন তত বাড়ত। ছিল হাত চরকি। এক বিরাট লম্বা কঞ্চির ডগায় সুদর্শন চক্রের মত ঘুরত সেই রঙিন বৃত্ত। যত বড় হত পূর্ণবেগে ঘোরার সময় তাকে ধরে রাখা ততই কঠিন হয়ে যেত। তবে শব্দবাজির তেমন জনপ্রিয়তা ছিল না। ধানিপটকা একেবারে ছোট্ট ছোট্ট পটকা। বাজিতে সবে হাত পাকাচ্ছে এমন কিশোরদের সবচেয়ে পছন্দের। ওষুধের বড়ির মতো দেখতে সাপবাজি, কিংবা রঙ দেশলাই কবেই হারিয়ে গিয়েছে। প্রবীণ ব্যবসায়ী উত্তম সাহা বলছিলেন উড়ন তুবড়ির কথা, “এখনকার তুবড়ি যেমন মাটিতে বসিয়ে ফাটান হয় উড়ন তুবড়ি নিজে উড়ে গিয়ে ফাটত। খুব দক্ষতা না থাকলে এ জিনিস চট করে কেউ ফাটাতে পারত না। তুবড়ির মুখে আগুন দিয়ে হাতে করে ঝাঁকিয়ে ঠিক সময় ছাড়তে হত। অন্ধকার আকাশে অদ্ভুত সব আলোর কল্কা আঁকতে আঁকতে সে যেত মিলিয়ে।”

মিলিয়ে গিয়েছে তারা। এখন হরেক কিসিমের নামীদামী বাজির ভিড়ে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেদার ফাটছে শব্দবাজি। সে সব কালীপুজো এলেই মনে পড়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE