Advertisement
E-Paper

থিমের টেক্কা থেকে সারদার পট, বিচিত্র দুর্গোত্‌সবে সামিল নবদ্বীপ

তেরো পার্বণের দেশ নবদ্বীপ বারো মাসই উত্‌সবে মেতে থাকে। রথ, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, রাস থেকে দোল। উত্‌সব যেন আর শেষ হয় না। আর তাতে মাতোয়ারা শুধু যে নবদ্বীপের মানুষ, তা তো নয়। সে সব উত্‌সবে যোগ দিতে ছুটে আসেন কলকাতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া কিম্বা হলদিয়া থেকে হল্যান্ড সব প্রান্তের বিচিত্র মানুষ।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৩৮

তেরো পার্বণের দেশ নবদ্বীপ বারো মাসই উত্‌সবে মেতে থাকে। রথ, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, রাস থেকে দোল। উত্‌সব যেন আর শেষ হয় না। আর তাতে মাতোয়ারা শুধু যে নবদ্বীপের মানুষ, তা তো নয়। সে সব উত্‌সবে যোগ দিতে ছুটে আসেন কলকাতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া কিম্বা হলদিয়া থেকে হল্যান্ড সব প্রান্তের বিচিত্র মানুষ।

তাই একদিকে যেমন বিবিধের মিলন, প্রতিদিন সমৃদ্ধ হয় নবদ্বীপের সমাজ-সংস্কৃতি। তেমনই আবার এই উত্‌সবকে ঘিরেই আবর্তিত হয় নবদ্বীপের অর্থনীতি। ব্যতিক্রম নয় দুর্গাপুজোও।

পুজোর মরসুমে শহরের আনাচে কানাচে কান পাতলেই শোনা যায় আফশোসের শব্দ, “নেহাত দুর্গা পুজোর ঠিক দেড়মাস পরেই রাস, তা না হলে নবদ্বীপও দেখিয়ে দিতে পারত দুর্গাপুজো কাকে বলে।”

তা বলে সত্যি সত্যি কি দুর্গাপুজোর জাঁকজমক কম হয় নাকি? কোনও ঘাটতি নেই দুর্গাপুজোর বহরে। শহর জুড়ে সাতলাখ, পাঁচলাখ বা সাড়ে-তিন তিনলাখ টাকা বাজেটের পুজোর অভাব নেই মোটেই।

সাবেকি প্রথার ডাকের সাজ থেকে হাল আমলের থিমের পুজো, খামতি নেই কোনও কিছুর। খামতি নেই একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার। উত্তরের বারোয়ারি আজাদ হিন্দ ক্লাবের প্রতিমা শিল্পী যদি অসম থেকে উড়ে আসেন তবে দক্ষিণের মণিপুর বারোয়ারির উদ্যোক্তারা ছোটেন কলকাতার স্টুডিওতে নিজেদের গাওয়া পুজোর ‘থিম সং’ রেকর্ড করতে।

শহরের কেন্দ্রস্থল পোড়ামাতলার পুজো উদ্যোক্তারা কয়েক হাজার মানুষকে প্রসাদ খাওয়ানোর আয়োজন করলে পাশের ক্লাব অমরভারতী বিতরণ করে শীতবস্ত্র। আবার বড়ালঘাট স্পোর্টিং আর্সেনিকের বিপদ থেকে সচেতন করতে উত্‌সবের দিনগুলিতে মানুষকে বিশুদ্ধ পানীয় জল দান করার উদ্যোগ নিয়েছে।

তবে যুবদল, তরুণসংঘ, রাধাবাজারের মতো ক্লাবগুলি আছে প্রতিমা মণ্ডপ আলোকসজ্জায় শ্রেষ্ঠত্বের চিরাচরিত টানাপোড়েন নিয়েই। অন্যদিকে চারপল্লী সর্বজনীন, দেয়ারাপাড়া সর্বজনীন, ভট্টপাড়া, তেঘড়িপাড়া বা কান্তি ভট্টাচার্য রোডের দুর্গোত্‌সব বা আগমেশ্বরী বাজার সর্বজনীন পুজোর উদ্যোক্তারা সাবেকিয়ানায় বিশ্বাসী। প্রতিবারের মতো এবারেও তাঁরা আড়ম্বরের বদলে নিয়মনিষ্ঠ পুজোপাঠেই বেশি যত্নবান। মণ্ডপের বাহার, আলোর রোশনাই নয়, বরং তাঁরা বেশি তত্‌পর পুজোকে নিখুঁত করে তুলতে।

কিন্তু শুধু এ টুকুই নয়। ভিন্নতর আরও এক বৈশিষ্ট নবদ্বীপের দুর্গাপুজোকে আলাদা মাত্রা দেয়। যেখানে অন্য যে কোনও জায়গার থেকে পৃথক নবদ্বীপ।

বৈষ্ণব তীর্থ নবদ্বীপের মঠমন্দিরে বছরভর লেগেই থাকে উত্‌সব। তার খ্যাতিতে দেশ ছাড়িয়ে এখন বিদেশও মাতোয়ারা। আন্তর্জাতিক মানের উত্‌সবের আয়োজন করে থাকেন সেই সব মঠ মন্দিরের কর্তৃপক্ষ। তেমনই বেশ কয়েকটি মন্দিরে দুর্গাপুজোর আয়োজনও করা হয়।

প্রচলিত পুজোর সঙ্গে তার অনেক ফারাক। কোথাও সারদা দেবীকে দুর্গারূপে পুজো করা হয়, তো কোথাও হরগৌরীর পুজো হয়। কোথাও প্রতিপদ থেকে শুরু হয়ে যায় চণ্ডীমূর্তির পুজো, কোথাও দেবী কাত্যায়নীর উপাসনা হয় বৈষ্ণব মতে।

নবদ্বীপের পশ্চিমপ্রান্তে সারদেশ্বরী আশ্রম। ১১৭ বছর ধরে দেবী দুর্গার বদলে এখানে সারদা মায়ের পট পুজো করা হয়। চণ্ডীপাঠ থেকে হোম পুজোর যা কিছু আচার, উপাচার সবই আশ্রমবাসী সন্ন্যাসিনীরা করে থাকেন। সাড়ম্বরে পালিত হয় কুমারী পুজো। বহুদূর থেকে মানুষ আসেন আশ্রমের কুমারী পুজো দেখতে।

ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন প্রতিষ্ঠিত হরিসভা মন্দিরেই দেড়শো বছর আগে শুরু হয়েছিল চৈতন্যদেবের বিগ্রহ গড়ে প্রকাশ্যে সেবাপুজো। সেই মন্দিরে আছে বহু প্রাচীন এক শ্বেতপাথরের হরগৌরী মূতি। মহাষ্টমীর দিনে সেখানে ষোড়শোপচারে দুর্গাপুজো হয়। আবার শিবরাত্রিতে হয় শিবের পুজো। বছরের বাকি দিনগুলি ওই বিগ্রহের পুজো অদ্বৈত সীতানাথ ধ্যানে হলেও মহাষ্টমীর দিনে কিন্তু চণ্ডীর ধ্যানেই পুজো হয়।

আবার সমাজবাড়িতে চিত্রপটে পুজো হয় দেবীদুর্গার। সেখানে প্রার্থনা মন্ত্রে চাওয়া হয় কেবল কৃষ্ণভক্তি। দেবীকে ভোগ দেওয়া হয় জগন্নাথের মহাপ্রসাদ। বিসর্জনের দিন দেবীকে দর্শন করানো হয় গঙ্গা। মহাপুজোর গোটা পর্ব জুড়েই থাকে কীর্তন।

নবদ্বীপের উত্তর প্রান্তে গঙ্গার কোল ঘেঁষে সতী দেবভাষা শিক্ষা নিকেতন আশ্রম। এখানে প্রাচীন গুরুকুলের মতো পদ্ধতিতে সংস্কৃত এবং শাস্ত্র শিক্ষা দেওয়া করা হয়। খুব ছোট থেকে আবাসিক হিসেবে থাকে পড়ুয়ারা। ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে পাঠদান।

এখানে প্রতিপদ থেকে শুরু হয় পুজো, নবরাত্রি। তবে দেবী দুর্গার বদলে চণ্ডীর পুজোই বিধান। গঙ্গার পাড় ঘেঁষা বিশাল যজ্ঞবেদীতে ন’দিন ধরে জ্বলে অনির্বাণ হোমাগ্নি। সেই সঙ্গে একলক্ষ মন্ত্রজপ করেন পুরোহিত। চলে একশো চণ্ডীপাঠ, আহুতি। মহাষ্টমীতে রাজকীয় আড়ম্বরে ন’জন কুমারীর পুজো হয়।

সেই পুজোর আয়োজনেই ব্যস্ত রয়েছে নবদ্বীপ।

nabadwip durga puja debashis bandopadhay theme pujo
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy