Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দু’শোতে পা, তবুও উপেক্ষিত কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কার

ছোটবেলার স্কুল পাঠ্যে ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসমকলি সকলি ফুটিল’ এ কবিতা পড়েননি এমন বাঙালি হাতে গোনা। এখনও কেউ কেউ চেষ্টা করলে কবিতার দু’এক ছত্র মনে করতে পারেন। কিন্তু বেশির ভাগ বাঙালিই জানেন না বাংলা শিশু সাহিত্যের সার্থক ওই কবিতার কবির নাম।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:১৪
Share: Save:

ছোটবেলার স্কুল পাঠ্যে ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসমকলি সকলি ফুটিল’ এ কবিতা পড়েননি এমন বাঙালি হাতে গোনা। এখনও কেউ কেউ চেষ্টা করলে কবিতার দু’এক ছত্র মনে করতে পারেন। কিন্তু বেশির ভাগ বাঙালিই জানেন না বাংলা শিশু সাহিত্যের সার্থক ওই কবিতার কবির নাম।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লেখাপড়ার গোড়াপত্তন হয়েছিল যাঁর বই পড়ে সেই ‘প্রভাত বর্ণনের’ কবিকে বেমালুম ভুলেছেন সবাই। তাই ২০১৫ সালে তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষের প্রাক্কালে বেসরকারি উদ্যোগে সামান্য দু’একটি অনুষ্ঠান ছাড়া প্রায় অনালোচিত থেকে গেলেন বিদ্যাসাগরের বন্ধু ও বাংলার নারীশিক্ষার প্রচার ও প্রসারের পুরোধা পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার।

১৮১৭ সালের ৩ জানুয়ারি নদিয়ার নাকাশিপাড়ার বিল্বগ্রামে জন্ম মদনমোহনের। বাবা রামধন চট্টোপাধ্যায় এবং মা বিশ্বেশ্বরী দেবী। সংস্কৃত কলেজের লিপিকর বাবা ‘বিদ্যারত্ন’ উপাধি পেয়েছিলেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মদনমোহন ছিলেন সবার বড়। ১৮২৯ সালে সংস্কৃত কলেজে পড়তে গিয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। ইয়ং বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাতা ডিরোজিওর উদ্যোগে সে সময়ে দেশ জুড়ে চলছে কুসংস্কার, নানা সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে ও ইংরেজি স্ত্রী শিক্ষার প্রসারের জন্য আন্দোলন। ইয়ংবেঙ্গলের অন্যতম সদস্য রামতনু লাহিড়ীর বাড়িতে থাকার সুবাদে মদনমোহনও সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারপর থেকে ১৮৫৮ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মদনমোহন শিক্ষা এবং সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত থাকেন।

১৮৪২ সালে হিন্দু কলেজের পাঠশালার প্রধান শিক্ষক হিসাবে মদনমোহন কর্মজীবন শুরু করেন। তারপর ১৮৪৬ সালে নদিয়ার রাজা শ্রীশচন্দ্র কৃষ্ণনগরে কলেজ স্থাপন করলে তিনি সেখানে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন। ১৮৪৬ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৮৫০-৫৪ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের জজ পণ্ডিত। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে নির্মাণেও তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

জীবনের শেষ পর্বে প্রশাসক হিসেবেও তিনি বেশ কিছু সংস্কারে হাত দেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মুর্শিদাবাদ এবং কান্দিতে দাতব্য চিকিৎসালয়, মেয়েদের স্কুল, রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। সেকালে শিক্ষা সংস্কারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেব যখন এদেশের মেয়েদের জন্য ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ স্থাপনে মদননোহন ছিলেন তাঁর প্রধান সহযোগী। বিনা বেতনে তিনি ওই স্কুলে পড়াতেন। শুধু তাই নয় তিনি তাঁর দুই মেয়ে ভুবনমালা এবং কুন্দমালাকে ওই স্কুলে ভর্তি করেন। শিশুদের জন্য লেখেন ‘শিশু শিক্ষা’ নামে একটি বই। যে বই দিয়ে শৈশবে রবীন্দ্রনাথের লেখাপড়া শুরু হয়েছিল। রবিজীবনীতে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। “রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা আরম্ভ হয়েছিল মদনমোহনকৃত শিশুশিক্ষা দিয়ে এবং তারপরে সম্ভবত বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল।”

১৮৪৯ সালে লেখা শিশুশিক্ষার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভাগ ১৮৫০ এর মধ্যে তাঁর লেখা হয়ে গিয়েছিল। বলা হয় বইটি ছিল বাঙলার প্রথম “প্রাইমার”। এর ঠিক পরেই তিনি লেখেন ‘স্ত্রীশিক্ষা’ নামে এর একটি বই। যেখানে তিনিই প্রথম বলেছিলেন শিশুকে শিক্ষিত করতে গেলে মায়েরই শিক্ষা আগে দরকার। এতো কৃতিত্বের অধিকারী হয়েও জন্মের দুশো বছর পূর্তির প্রাক্কালে বঙ্গ সমাজে তিনি ব্রাত্যই রয়ে গেলেন।

মদনমোহনের জন্মদিনে বিল্বগ্রামে “মদনমোহন তর্কালঙ্কার স্মৃতিরক্ষা কমিটির” উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানই ছিল তাঁর স্মরণে একমাত্র বড় অনুষ্ঠান। পাশাপাশি শনিবার, ৩ জানুয়ারি ১৯৯তম জন্মদিনে নদিয়া থেকে প্রকাশিত ‘মিষ্টিমুখ’ পত্রিকা প্রকাশ করেছে বিশেষ মদনমোহন তর্কালঙ্কার স্মরণসংখ্যা। বেথুয়াডহরিতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কথাশিল্প আবৃত্তি চর্চাকেন্দ্র মদনমোহনের স্মৃতিতে একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেন। নদিয়ার আসাননগরের মদনমোহন তর্কালঙ্কার কলেজে আয়োজিত হয়েছে একটি আলোচনা সভা। যদিও বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে এ দিন তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহনকে ভুলেই ছিল।

মিষ্টিমুখের সম্পাদক প্রীতম ভট্টাচার্য বলেন, “বছরভর নানা মনীষীদের জন্মদিন ঘটা করে পালন করা হলেও মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জন্মদিন পালনে প্রশাসনের কোনও উদ্যোগই চোখে পড়ল না।” তিনিও আরও বলেন, “আমাদের আর কতটুকু সামর্থ্য। যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁরা উদ্যোগ নিন এটাই আমাদের দাবি।”

বছর দুয়েক আগে মদনমোহন তর্কালঙ্কার স্মৃতিরক্ষা কমিটির অনুষ্ঠানে এসেছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত সাহা, কৃষ্ণনগরের সাংসদ তাপস পাল। হাজির ছিলেন নাকাশিপাড়ার বিধায়ক তৃণমূলের কল্লোল খা।ঁ সুব্রতবাবু জানিয়েছিলেন, বেথুয়াডহরি অভয়ারণ্য মদনমোহনের নামে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা হয়নি। কল্লোল খাঁর উদ্যোগে অভয়ারণ্যের সামনে বসেছে একটি আবক্ষ মূর্তি। কিন্তু মাথার উপরে কোনও ছাউনি না থাকায় ধুলোয় প্রায় ঢাকা পড়েছে মূর্তি। কল্লোলবাবু বলেন, “অভয়ারণ্যের নামকরণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দফতরকে লিখিত ভাবে জানিয়েছি। কিন্তু এখনও কোনও উত্তর পাইনি।”

কল্লোলবাবু জানান ইতি মধ্যে বেথুয়াডহরি কলেজে একটি অডিটরিয়াম এবং তার জন্মভিটাতে একটি গ্রন্থাগার মদনমোহনের নামে করা হয়েছে। যদিও এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ গ্রন্থাগারে কিছুই মেলে না। নদিয়ার মানুষের দাবি সরকারি উদ্যোগে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মতো মানুষের দ্বিশতবর্ষ রাজ্য জুড়ে পালিত হোক। কিন্তু সেই দাবি আদৌ কার্যকরা হবে কিনা জানা নেই। আপাতত একটি আবরণহীন আবক্ষ মূর্তি, একটি নামাঙ্কিত গ্রন্থাগার একটি কলেজে বা অডিটোরিয়াম আর অনেক ‘হচ্ছে হবে’র উপর ভরসা করে আপাতত দু’শো বছরের দিকে পা বাড়ালেন পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madanmohan tarkalankar debashis bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE