Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

নীল চাষের ‘হেরেনঘাটা’য় কারখানার স্বপ্ন

গ্রাম বলে গ্রাম। নাম দলুইপুর। মাঝ বরাবর চলে গিয়েছে আঁকাবাঁকা মোরামের রাস্তা। বর্ষায় নিচু সেই রাস্তায় জল উঠে যায়। রাতে ঘুটঘুট্টে অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে এক গ্রামবাসী তাঁর সঙ্গীকে ভরসা জোগান, “আর ক’টা দিন। পুরসভা হয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। শহরের মতো এখানেও পাকা রাস্তা হবে, দু’ধারে আলো।” রাস্তা কবে হবে জানা নেই। তবে, এটা ঠিক, হরিণঘাটা ২ পঞ্চায়েতের দলুইপুর গ্রামটির এখন পরিচয় হরিণঘাটা পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড।

সৌমিত্র শিকদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৪ ০১:০৪
Share: Save:

গ্রাম বলে গ্রাম। নাম দলুইপুর। মাঝ বরাবর চলে গিয়েছে আঁকাবাঁকা মোরামের রাস্তা। বর্ষায় নিচু সেই রাস্তায় জল উঠে যায়। রাতে ঘুটঘুট্টে অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে এক গ্রামবাসী তাঁর সঙ্গীকে ভরসা জোগান, “আর ক’টা দিন। পুরসভা হয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। শহরের মতো এখানেও পাকা রাস্তা হবে, দু’ধারে আলো।”

রাস্তা কবে হবে জানা নেই। তবে, এটা ঠিক, হরিণঘাটা ২ পঞ্চায়েতের দলুইপুর গ্রামটির এখন পরিচয় হরিণঘাটা পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড। তিনশোর মতো মুসলিম পরিবার অধ্যুষিত গ্রামটিতে বিদ্যুৎ এসেছে খুব বেশি দিন নয়। পুরসভা হয়েছে শোনার পর গ্রামবাসীর আশা, এ বার পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে যাবে বাড়িতে। নিকাশিনালা দিয়ে বেরিয়ে যাবে বৃষ্টির জল। গ্রামের বাসিন্দা বছর ষাটেকের কৃষক জিয়াউল হকও অন্যদের মতো আশায় বুক বেধেছেন। শুধু শহুরে সুবিধা নয়, শিল্প, কারখানা কর্মসংস্থানেরও স্বপ্ন দেখছেন তিনি। তাঁর কথায়, “আজকের যুগে কর্মসংস্থানটা সবচেয়ে জরুরি। এখানে চাষবাস বেশি। ফলে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প হলে খুব ভাল হয়।”

এই ভাবেই নতুন পুরসভা হরিণঘাটাকে নিয়ে প্রত্যাশার পারদ ক্রমশ চড়ছে। সেই হরিণঘাটা, যেখানে ব্রিটিশ আমলে নীল চাষ হত বিঘার পর বিঘা জমিতে। একদিকে ইছামতী আর এক দিকে গঙ্গার মাঝে যমুনা নদীপথে নীলকর সাহেবরা চলাচল করতেন। তাঁদের থাকার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছিল নীলকুঠী। এখানেও সেই রকম একটি কুঠী ছিল। সেখানে হেরেন নামে একজন সাহেব থাকতেন। তাঁর নামেই নামকরণ হেরেনঘাটা। যা থেকে পরে হয় হরিণঘাটা।

একদা যেখানে চাষবাসই ছিল মুখ্য জীবিকা, স্বাধীনতার পরে সেখানে ক্রমশই চাকরিজীবীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কলকাতা থেকে কম-বেশি ৫০ কিলোমিটার দূরে এই জনবসতিতে শহুরে জীবনযাত্রার ছাপ পড়তে থাকে ক্রমশ। বিশেষ করে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ও রাজ্য সড়কের মিলনস্থল বড় জাগুলিয়া মোড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় কেন্দ্র গড়ে ওঠে। শহুরে সুবিধার অন্যতম অঙ্গ ভাল-ভাল স্কুল, হাসপাতাল গড়ে ওঠে। মোহনপুর বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হরিণঘাটা ফার্ম, নদী গবেষণা কেন্দ্র, জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়, বিএসএফ ক্যাম্পকী নেই? এই প্রেক্ষিতে হরিণঘাটাকেও পুরসভা করার দাবি ক্রমশ জোরালো হতে থাকে। চাকদহ, কল্যাণী, গয়েশপুর পুরসভা হলে হরিণঘাটা কেন নয়, সেই প্রশ্ন তুলতে থাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের প্রত্যাশা আরও বাড়িয়ে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদের ভট্টাচার্য ২০০৯ সালের ফেব্রয়ারি মাসে এলাকায় একটি জলপ্রকল্পের উদ্বোধন করতে এসে প্রকাশ্য সমাবেশে হরিণঘাটাকে পুরসভা করার পক্ষে সায় দেন।

২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি তৎকালীন বামফ্রন্ট রাজ্য সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রথম বিষয়টি গৃহীত হয়। যে সব পঞ্চায়েত এলাকা নিয়ে পুরসভাটি গঠিত হবে, তাদের আয় ও ব্যয়, পঞ্চায়েতে কর্মীর সংখ্যা কত, অর্থাৎ পুরসভা হলে আরও কত কর্মীর প্রয়োজন, অতিরিক্ত কত টাকা ব্যয় করতে হবে ইত্যাদি নিয়ে সমীক্ষা শুরু হয়। সমীক্ষা অনুযায়ী ২৭.১১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত এই পুরসভায় সেই সময় হরিণঘাটা ১ ও ২ পঞ্চায়েত দু’টির সম্ভাব্য বার্ষিক আয় ছিল ২৬ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা, আর সম্ভাব্য ব্যয় ছিল ১৩ লক্ষ ১২ হাজার ৮১২ টাকা, অর্থাৎ সম্ভাব্য উদ্বৃত্ত্ব ছিল ১৩ লক্ষ ৫৭ হাজার ১৮৮ টাকা। এ ছাড়া এলাকার মূল জীবিকা কী, জনবসতির ঘনত্ব কত, ইত্যাদি নিয়েও সমীক্ষা হয়। মোটামুটি ভাবে সব দিকেই পাশ করে

যায় হরিণঘাটা। পুরসভা করার জন্য ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনার কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন হরিণঘাটার তৎকালীন বিধায়ক তথা প্রাক্তন রাষ্ট্রমন্ত্রী বঙ্কিম ঘোষ। ওই বছর ২২ ডিসেম্বর রাজ্যের অর্থ দফতর হরিণঘাটা প্রস্তাবিত পুরসভা গঠনে সম্মতি দেয়। ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি রাজ্য মন্ত্রিসভায় বিষয়টি পাশ হওয়ার পর মাননীয় রাজ্যপালের কাছে পাঠানো হয়। তিনি ২০১১ সালের ২ মার্চ এতে স্বাক্ষর করেন। সেই সমস্ত হিসাব-নিকাশ দিয়ে বঙ্কিমবাবু বলেন, “হরিণঘাটা পুরসভা গঠনে আমরাই যা করার করেছি। সেই সময় বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় পুর দফতরের পক্ষ থেকে গেজেট প্রকাশ করা যায়নি। আমরা ক্ষমতায় এলে অনেক আগেই এই কাজ সেরে ফেলতাম।” এ দিকে আগে যা-ই কাজ হয়ে থাক, তৃণমূলের জমানায় পুরসভার ঘোষণা হয়েছে। বামফ্রন্টকে সেই কৃতিত্বের ভাগীদার করতে মোটেই রাজি নয় তারা। জেলা তৃণমূল যুব সভাপতি তথা বিধায়ক রত্না ঘোষ বলেন, “রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরই আমরা হরিণঘাটা পুরসভা গঠনে উদ্যোগী হয়েছিলাম। সাংসদ মুকুল রায়েরও ভূমিকা রয়েছে।”

হরিণঘাটার বিডিও আব্দুল মান্নান জানান, চলতি বছর ২ জানুয়ারি প্রস্তাবিত এই পুরসভার নোটিফিকেশন জারি হওয়ার পর থেকেই প্রশাসনিক কাজকর্ম শুরু হয়ে গিয়েছে। সামনেই রাজ্যের ১৭টি পুরসভায় ভোট হওয়ার কথা। সেই তালিকায় রয়েছে হরিণঘাটাও। ভোটের পরেই এখানে নতুন পুরবোর্ড গঠন করা হবে। নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিম জানান, আপাতত হরিণঘাটা পুরসভায় কল্যাণীর মহকুমাশাসক প্রশাসক হিসাবে দায়িত্বে রয়েছেন।

অর্থাৎ ভোটের উপরেই নির্ভর করছে পুরসভা গঠনের চূড়ান্ত ধাপ। হরিণঘাটার বাসিন্দারা তাই অধীর আগ্রহে পুরভোটের দিন ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছেন।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

soumitra sikdar neel cultivation haringhata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE