Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পুরসভার দাবি জোরালো হচ্ছে ডোমকলে

কথিত আছে, বারো ভুঁইয়াদের দমন করতে ১৬০৭ সাল নাগাদ মনসবদার আজিম খাঁ সৈন্য-সামন্ত নিয়ে উপস্থিত হন শেয়ালমারির কোল ঘেঁষা এলাকায়। শোনা যায়, তখন থেকে এই এলাকার নাম হয় আজিমগঞ্জ। সৈন্যদের চাহিদা মেটাতে আশপাশের গ্রাম থেকে চাষিরা তাঁদের উত্‌পাদিত শাক সব্জি থেকে আনাজ জড়ো করতে শুরু করেন অধুনা ডোমকলের এই এলাকায়। সৈন্যদের দেখে স্থানীয় কিছু পরিবারও কেনাকাটা শুরু করেন এখান থেকেই।

নেই ফুটপাথ। অগত্যা সংকীর্ণ রাস্তা দিয়েই যাতায়াত। ছবি: বিশ্বজিত্‌ রাউত।

নেই ফুটপাথ। অগত্যা সংকীর্ণ রাস্তা দিয়েই যাতায়াত। ছবি: বিশ্বজিত্‌ রাউত।

সুজাউদ্দিন
ডোমকল শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৫ ০১:২০
Share: Save:

কথিত আছে, বারো ভুঁইয়াদের দমন করতে ১৬০৭ সাল নাগাদ মনসবদার আজিম খাঁ সৈন্য-সামন্ত নিয়ে উপস্থিত হন শেয়ালমারির কোল ঘেঁষা এলাকায়। শোনা যায়, তখন থেকে এই এলাকার নাম হয় আজিমগঞ্জ। সৈন্যদের চাহিদা মেটাতে আশপাশের গ্রাম থেকে চাষিরা তাঁদের উত্‌পাদিত শাক সব্জি থেকে আনাজ জড়ো করতে শুরু করেন অধুনা ডোমকলের এই এলাকায়। সৈন্যদের দেখে স্থানীয় কিছু পরিবারও কেনাকাটা শুরু করেন এখান থেকেই।

প্রবীণদের কথায়, সেই শুরু ডোমকল হাটের। দিনে দিনে জমে ওঠে হাট, হাটকে ঘিরে বসে দোকানপাট। ইতিমধ্যে ইংরেজরা চাষের আদর্শ জায়গা এবং রাজশাহি-সহ পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন শহরের জলপথে যোগাযোগের অন্যতম উপায় হিসেবে বেছে নেয় ডোমকলকে। মেহরপুর, শিকারপুরের থেকেও বড় কুঠিবাড়ি তৈরি হয় এখানে। দিনে দিনে গঞ্জ থেকে ডোমকল বাজার আড়েবহড়ে বাড়ে। এক সময় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯৯৯ সালে ১৬ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদের নতুন মহকুমার স্বীকৃতি পায় ডোমকল। ভৈরবের পূর্বপাড়ে নতুন মহকুমা নিয়ে টানাপড়েনও হয়েছে অনেক। এমনকি গঞ্জ ইসলামপুর না ডোমকল, মহকুমা কোন এলাকা হবে তা নিয়ে জল ঘোলা হয় বিস্তর। শেষে ডোমকলকেই মহকুমা ঘোষণা করেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তারপর ডোমকল একটু একটু করে বেড়েছে। কিন্তু অভিযোগ প্রায় পুরোটাই অপরিকল্পিত ভাবে! কেমন?

গঞ্জ থেকে শহর হলেও পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি সে ভাবে। প্রশাসনিক ভবন হলেও আদালত থেকে বেশ কিছু জরুরি দফতর এমনকি দমকলের মত পরিষেবাও পায়নি এই শহরবাসী। রাস্তা, পানীয় জল, আলোর মতো পরিষেবাও নেই। এখনও নেই বিনোদনের মতো কোনও জায়গা। একটি মাত্র খেলার মাঠ বছরের বিভিন্ন সময়ে নানা অনুষ্ঠানে বেহাল। পরিকল্পিত কোনও বাজার গড়ে ওঠেনি এই শহরে। ফলে অবৈধ নির্মাণ থেকে হকারের দাপটে দিনের পর দিন রাস্তা সংকীর্ণ হয়েছে। নিকাশি নালা না থাকায় বর্ষা এলেই হাঁটু জল জমছে গোটা বাজার এলাকায়।

কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? পঞ্চায়েতের বক্তব্য, পঞ্চায়েতের পক্ষে এত বড় শহর এলাকার দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। স্থানীয় আজিমগঞ্জ গোলা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান কংগ্রেসের আলম খাঁ বলেন, “শহর অনেক বড় হয়েছে। একটা গ্রাম পঞ্চায়েতের পক্ষে এর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। তবু আমরা বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে শহরের মান রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছি।’’

মহকুমা শহর হওয়ায় সরকারি, বেসরকারি কিছু দফতরের অফিসও রয়েছে ডোমকলে। বেড়েছে শিক্ষা থেকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ১৫ বছর পার হলেও মহকুমা শহরে হয়নি পৌরসভা। বহু জায়গায় এখনও নিকাশি ব্যবস্থা নেই। শহরের অনেক গলি এখনও কাঁচা। নেই পথবাতি। শহরের মধ্যে বাজারে রাস্তার দু’ধার দিয়ে বসে সব্জি বিক্রেতা। নেই মাছ বা মাংসের জন্য বাজার। ফলে রাস্তার দু’ধার দিয়ে চলে কেনাবেচা। একটু বড় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সব্জি বিক্রেতাদের দাপটে তাঁদের ক্রেতাদের সাইকেল রাখাও দায়। রাস্তা এতটাই সরু হয়ে গিয়েছে যে বাজারের গুরত্বপূর্ণ এলাকায় আগুন লাগলেও দমকলের ইঞ্জিন প্রবেশের পথ নেই। ডোমকলবাসীর আক্ষেপ, মহকুমার তকমা লাগার ১৫ বছর পরেও দমবন্ধ অবস্থাটা ঘুচল না! এ প্রসঙ্গে ডোমকলের মহকুমাশাসক পুষ্পেন্দু মিত্র বলেন, “রাস্তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।”

পুরসভা না হলেও শহরের জন সংখ্যা লাখ ছুঁই ছঁুই। পঞ্চায়েতের সৌজন্যে বেশ কিছু নিকাশি নালা হলেও তা নিয়মিত পরিস্কার না হওয়ায় সেগুলি বন্ধ। ডোমকল বাজারের ব্যবসায়ী অনুপ চক্রবর্তীর কথায়, মধ্য বাজারের সঙ্গে ডোমকলের অনেক ইতিহাস জড়িত। এই বাজার ডোমকলের প্রথম বাজার। ফলে বড় ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানও এই এলাকায়, অথচ এই বাজার বর্তমানে শহরের অন্যতম নোংরা এলাকা বলে পরিচিত। সব্জি বিক্রেতাদের দাপটে এই বাজারকে এড়িয়ে চলেন মানুষ। তা ছাড়াও কেনাকাটা করতে এসে বড় গাড়ি দূরের কথা, সাইকেল বা মোটর বাইক রাখার উপায় থাকে না।’

হকার বা অবৈধ নির্মাণের কোপে রাস্তার বেহাল দশা। অন্য দিকে, সেই রাস্তায় সন্ধ্যা নামলেই নেমে আসে অন্ধকার। পৌর এলাকা না হওয়ায় নেই পথবাতিও। ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগে কিছু বাল্ব ঝুলিয়ে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা হলেও বিদ্যুতের বিল মেটাতে নাজেহাল সমিতি। ফলে ওই পরিষেবাও প্রায় এলাকায় বন্ধ। রাজ্য সড়ক ধরে গ্রাম পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে ত্রিফলা বাতি লাগানোর পর বছর না ঘুরতেই অনেক জায়গায় বিকল হয়ে পড়েছে বাতি। ডোমকল বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি পার্বতীশঙ্কর নন্দী বলেন, ‘‘শহরের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। বরং দ্রূত অপরিকল্পিত ভাবে বেড়ে ওঠা শহরে দিনের পর দিন তৈরি হচ্ছে নতুন সমস্যা।” তাঁর মত, দ্রুত পৌরসভা না হলে এই শহর আগামী দিনে আরও বড় বিপদে পড়বে।

অভিযোগ, শহরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে অনেক কিছুই। যেমন শৌচাগার, পানীয় জলের ব্যবস্থা। সংরক্ষণের অভাবে সে সবের অধিকাংশই আবার বিকল। কোনও শৌচাগারে তালা, কোথাওবা পরিছন্নতার অভাবে ভেতরে ঢোকা দায়! লক্ষ টাকা ব্যয়ে ঝকঝকে পানীয় জলের ব্যবস্থা হলেও তাতে জলের দেখা নেই। এমনকি শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা প্রশাসনিক ভবন বা মহকুমা হাসপাতালেও পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। ডোমকল বাজারের ব্যবসায়ী স্বপন মিস্ত্রির ক্ষোভ, ‘‘যেন অভিভাবকহীন একটা শহর। এমনিতেই নেই এর তালিকা লম্বা। যেটুকু হচ্ছে, সেটাও দেখার নেই কেউ।’’ মহকুমাশাসক পুষ্পেন্দুবাবুও মানছেন, “অনেক কিছু নেই, তা ঠিক। কিন্তু, কম সময়েই মধ্যেই মহকুমা শহর হিসেবে এলাকার অনেক উন্নতিই হয়েছে।”

মহকুমাশাসকের সঙ্গে অনেকে আবার একমত নন। তাঁরা জানাচ্ছেন, বছর কয়েক আগে নতুন শহরে শিশুদের জন্য গড়ে উঠেছিল একটি পার্ক। আব্দুল বারি নামের ওই পার্কটি বর্তমানে দিনে গরু ছাগলের বিচরণ ক্ষেত্র আর সন্ধ্যা নামলেই মাতালদের দখলে থাকে বলে অভিযোগ। সাংস্কৃতির চর্চা কেন্দ্র রবীন্দ্র নজরুল সদনটি রাষ্ট্রপতির হাত ধরে উদ্বোধন হলেও আদতে ব্যবহারের এখনও উপযোগী হয়নি।

তবুও ডোমকল তাকিয়ে আছে একটা স্বপ্নের শহরের দিকে। কবে বাস্তবায়িত হয়, দেখার সেটাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor sujauddin domkal municipality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE