কৃষ্ণনগরের স্কুলে পুজোর থিম।—নিজস্ব চিত্র।
রঙিন সুতো, থার্মোকল, কাপড় বা পাটকাঠির মণ্ডপে সাদা আলপনা আর ফুলের টবে কাঁচা হাতের কারিগরি নয়। রীতিমতো ভাবনা চিন্তার ফসল হিসেবে উঠে এসেছে এক একটি মণ্ডপ। তাও দু’তিন লক্ষ টাকা বাজেটের ক্লাবের পুজো নয়। স্কুল স্কুলে ছাত্রদের করা পুজো দেখেই তাক লেগেছে কৃষ্ণনগরবাসীর।
থিমের ঠেলায় অবশ্য অনেকেই বিরক্ত। অনেকেই বলছেন, এ আবার কী? বিদ্যাদেবীর এ কেমন রূপ? এত কারিগরিতে যে ভক্তিটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু অনেকেই বিস্মিত স্কুল কলেজের পুজো মণ্ডপে থিমের ব্যবহার দেখে। কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন স্কুল যেভাবে সেজে উঠেছে তাতে অবাক হয়েছেন অভিভাবকরাও। কেউ কেউ বলছেন ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলো এতকিছুও ভাবতে পারে!
কৃষ্ণনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের স্কুলে ফুটিয়ে তুলেছে ভয়াবহ সেই ছবি। পেশোয়ারে নিহত শতাধিক ছাত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই তাদের এই থিম ভাবনা, বলেছে ছাত্ররাই। স্কুলে পুজো হয়েছে যেমন হয়। কিন্তু ফাঁকা ক্লাস ঘর লাল রঙের রক্তে ভেসেছে, দেওয়াল জুড়ে নৃশংসতার ছবি। অন্যদিকে শৈশবের সারল্য নিয়ে উঠে এসেছে মিকি মাউস, টম, জেরির মতো নানান কার্টুন চরিত্র। এ যেন অদ্ভুত এক বিপরীত্য। আবার এ এক ঘোর বাস্তব। প্রধান শিক্ষক উত্পল ভট্টাচার্য বলেন, “এখন ছাত্রছাত্রীরা অনেক বেশি সৃজনশীল। আগেও মণ্ডপ সাজানো হত, কিন্তু সেটা এত পরিকল্পিত ভাবে হত না। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো এখানে অনেক বেশি পরিণত।”
কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে আবার থিম ‘আদ্যাশক্তি মহাসরস্বতী’। এভি স্কুলে থিম সাজানো হয়েছে তাদের প্রক্তন ছাত্র বাঘা যতীনের আত্মোত্সর্গের শতবর্ষকে মাথায় রেখে। বাঘাযতীনের জীবনী, বুড়িবালামের তীরে সংঘর্ষ সবই উঠে এসেছে স্কুল চত্বরে। শক্তিনগর হাই স্কুলের থিমে রয়েছেন যামিনী রায়। অন্যদিক ঘূর্ণী উচ্চ বিদ্যালয়ের আকর্ষণ বাংলার হারিয়ে যাওয়া আলপনা। যে আলপনা সরস্বতী পুজোর অন্যতম উপাচার। চটের উপরে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বিশেষত্ব-সহ আলপনাকে ফুটিয়ে তুলেছে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। শুধু কৃষ্ণনগর নয়। ফুলিয়া শিক্ষানিকেতনেও হয়েছে থিমের পুজো। ছাত্রদেরই আঁকা প্রায় তিন হাজার গ্রিটিংস কার্ড দিয়ে মণ্ডপ সাজিয়েছে তারা। আবার শান্তিপুর মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল থিম হিসাবে বেছে নিয়েছে বিজ্ঞানকে। সেখানে বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের উপরে মডেল করে সাজানো হয়েছে মণ্ডপ।
এ দিকে সরস্বতী পুজোর ধুম লেগেছে নবদ্বীপেও। বিশেষত নবদ্বীপের উত্তরে প্রাচীন মায়াপুরে। কয়েক দশক আগেও এই অঞ্চলে ব্যপক ধুমধাম করে সরস্বতী পুজো হত। মাঝে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আবার নতুন করে ফিরে আসছে সরস্বতী পুজোর সেই হারানো জৌলুশ। নেতা-মন্ত্রী কে দিয়ে একদিন আগে ফিতে কেটে প্রতিমা উদ্বোধন এবং তারপর তিনদিন ধরে টানা সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,অর্কেস্ট্রা, সকালের দিকে দুস্থদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ,নরনারায়ণ সেবা সব মিলিয়ে জমজমাট প্যাকেজ। তবে সরস্বতী পুজোয় এ বারের সেরা প্রাপ্তি দু’দিনের হুল্লোড়। সেই দুর্গাপুজো থেকে যে তিথি বিভ্রাটের সূচনা তার জের সরস্বতীতেও চলছে। কোথাও শনিবার কোথাও রবিবার, পুজো হয়েছে। ফলে টানা দু’দিনের উত্সব। সেই সঙ্গে লক্ষ লক্ষ টাকার বাজেট। ফলে পুজো আড়ম্বরে কোথাও কোনও খামতি নেই।
প্রাচীন মায়াপুরের ফ্রেন্ডস ইলেভেন ক্লাবের ২৬ তম বর্ষ। তাদের বাজেট দু লক্ষ টাকা। চোখ ধাঁধানো আলো, বিশাল মণ্ডপ, সঙ্গে সপ্তাহ ভর মেলা। প্রাচীন মায়াপুর যুবদল ক্লাবের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ। তাদের থিম গ্রামবাংলা। গাই-বাছুর, মোরগ, টিয়াপাখি, পাতকুয়ো সমেত জলজ্যান্ত একটা গোটা গ্রামই গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তরা। সম্পাদক প্রকাশ সাহা বলেন, “তিন মাস ধরে ক্লাবের জনাকুড়ি সদস্য একটু একটু করে গ্রামটি তৈরি করেছেন।” সীতানাথ লেনের মণ্ডপ আবার তৈরি হয়েছে কাঁসা পিতলের নানা মোটিফ দিয়ে। যোগনাথ তলা বারোয়ারির বাজেটও প্রায় দুই লাখ ছুঁই ছুঁই। সাবেক বড় প্রতিমা গড়েছে পোড়ামাতলা বারোয়ারি। আবার বুড়োশিবতলা ফ্রেন্ডস ক্লাবের সদস্য অরূপ সাহা নিজে হাতে তৈরি সুবিশাল প্রতিমা তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। প্রায় দু’মাস ধরে ক্লাবের অন্যদের সাহায্যে নিজেই সরস্বতী গড়েছেন অরূপ বাবু।
তবে এরই পাশে রয়েছে ঐতিহ্যের আরাধনা। বৈষ্ণবশাস্ত্র মতে, শ্রীপঞ্চমীর দিন থেকেই ঋতু বসন্তের সূচনা। মন্দিরে মন্দিরে এ দিন থেকে কীর্তনের সুরে বসন্ত রাগের ছোঁয়া। পুজোর উপকরণে আবির, কুমকুমের অনিবার্য উপস্থিতি। বলা হয় সরস্বতী পুজো আসলে বসন্তোত্সবের সূচনা। যা সমাপ্ত হয় দোল পূর্ণিমায়।
অষ্টাদশ শতকে নব্য ন্যায়ের চর্চায় নবদ্বীপের খ্যাতি যখন ভুবনজোড়া, গঙ্গার তীরবর্তী সেকালের নবদ্বীপ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় নগর, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। সেকালে সমাবর্তন হত জনপদের মাঝখানে এক বটগাছের নীচে। তারপরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। নবদ্বীপ হারিয়ে ফেলেছে তার বিদ্যা-গৌরব। ‘মৃত ভাষা’ সংস্কৃতের চর্চা করতে আজ আর কেউ নবদ্বীপে আসেন না। শুধু রয়ে গিয়েছে সেই বটগাছটি, একদা যার তলায় নিয়মিত বসত সে কালের ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ মানের বিতর্কসভা।
নবদ্বীপের প্রাণকেন্দ্র পোড়ামাতলা সেই বটগাছকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। নবদ্বীপের অধিষ্ঠাত্রি দেবী হিসাবে এই বটগাছটির ষোড়শপচারে পুজো হয় প্রতিদিন দক্ষিণাকালীর ধ্যানে। কেবল বছরের একটি দিন সেখানে সরস্বতীর পুজো হয়। সেদিন পুজো হয় তন্ত্রোক্ত নীল সরস্বতী বা মহা সরস্বতীর। এই শহরের বহু পুরানো পরিবারের হাতেখড়ি এখনও এখানে হয়। বহু প্রবীণ মানুষ নিয়ম করে আজও এখনেই অঞ্জলি দিয়ে থাকেন।
কিন্তু কেন এমন প্রথা? কিছুটা উত্তর মেলে “নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার ইতিহাস” বইয়ে। পণ্ডিত গোপেন্দুভূষন সাংখ্যতীর্থ সেখানে লিখেছেন, পোড়ামা নামটি নিয়ে নানা মত আছে। যেহেতু এখানে স্মরণাতীত কাল থেকে বিদ্যাচর্চা হয়েছে তাই পড়ুয়াদের মা থেকে পোড়ামা। কেউ মনে করেন আগে এখানে তন্ত্রোক্ত নীল সরস্বতীর পুজো হত। মুসলমান আক্রমণের সময় তারা সেই দেবী মূর্তি পুড়িয়ে দেয়, তারপর থেকে লোকমুখে পোড়ামা। নবদ্বীপের পোড়ামাকে বিদগ্ধজননী বলা হয়। পণ্ডিতদের কাছে বিদগ্ধ শব্দের অর্থ বিশেষ রূপে শিক্ষিত হলেও সাধারনের কাছে হয়ত ‘দগ্ধ’ শব্দ থেকেই পোড়ামা হয়ে গিয়েছে।
তবে যাই বলা হক না কেন, পোড়ামা আসলে বিদ্যার আধিষ্ঠাত্রি দেবী এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সরস্বতী পুজোর দিন নবদ্বীপ তার হারিয়ে যাওয়া অতীতকে একবার করে ছুঁতে চায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy