Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘পলাতক’ তৃণমূল নেতা বাড়িতে, গ্রামছাড়াদের বাইরে রেখেই ভোট

পুলিশের খাতায় তিনি পলাতক। অথচ খুনের ঘটনায় অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত সেই আশরাফ শেখই বিরোধীশূন্য গ্রামে দাপটের সঙ্গে ‘শান্তির’ ভোট পরিচালনা করলেন। সকালের দিকে একপাক বুথের দিকে ঘুরেও এসেছেন। সব কিছু ঠিকঠাক চলছে বুঝে সকাল-সকাল বাড়ি ঢুকে যান তিনি। বাড়িতে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি দেখে রীতিমত আতিথেয়তা করে ‘পলাতক’ তৃণমূল নেতার পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘পালিয়ে থাকব কেন? আমি তো গ্রামেই আছি। সকালে বুথেও গিয়েছিলাম। ঘুরে-ঘুরে দেখলাম।’’

বাড়িতে আশরফ শেখ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

বাড়িতে আশরফ শেখ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

সুস্মিত হালদার
চাপড়া শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৪ ০১:৩০
Share: Save:

পুলিশের খাতায় তিনি পলাতক। অথচ খুনের ঘটনায় অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত সেই আশরাফ শেখই বিরোধীশূন্য গ্রামে দাপটের সঙ্গে ‘শান্তির’ ভোট পরিচালনা করলেন। সকালের দিকে একপাক বুথের দিকে ঘুরেও এসেছেন। সব কিছু ঠিকঠাক চলছে বুঝে সকাল-সকাল বাড়ি ঢুকে যান তিনি। বাড়িতে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি দেখে রীতিমত আতিথেয়তা করে ‘পলাতক’ তৃণমূল নেতার পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘পালিয়ে থাকব কেন? আমি তো গ্রামেই আছি। সকালে বুথেও গিয়েছিলাম। ঘুরে-ঘুরে দেখলাম।’’

‘শান্তির ভোট’ এই ভাবেই হয়। ‘শান্তির ভোট’ এই ভাবেই হল চাপড়ার বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন প্রত্যন্ত গ্রাম বেতবেড়িয়ায়।

দাপুটে এই তৃণমূল নেতার স্ত্রী আলেয়া বিবি শেখ হৃদয়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান। এলাকার সকলে অবশ্য আশরফ শেখকে প্রধান বলেই জানেন। গত পঞ্চায়েত ভোটে আসরাফ শেখের বিরুদ্ধে হুমকির অভিযোগ তুলে চারটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও একটি পঞ্চায়েত সমিতির আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েও পরে তা প্রত্যাহার করে নেন সিপিএম প্রার্থীরা। পঞ্চায়েত ভোটের পরে গ্রামের হাইস্কুলের পরিচালন সমিতির ভোটে প্রার্থী দিয়েছিল সিপিএম। নির্বাচনের দিন ভোটদান শেষ হয়ে যাওয়ার পরে এক সিপিএম প্রার্থীর ভাইকে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়। গুরুতর জখম হন আরও এক ভাই। তাঁকে পরদিন গ্রামের বাইরে মাঠের ভিতরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করেন পরিবারের লোকজন। শুধু তাই নয় ওই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বেশ কিছু সিপিএম সমর্থকের বাড়িও ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই দিন রাতেই ভয়ে গ্রামছাড়া হন নিহতের দশ ভাই ও তঁদের পরিবার। মৃতদেহ গ্রামে ঢুকতে না দেওয়ায় পাশের কাঠগড়া গ্রামে কবর দিতে হয় আশাদুলকে। এর সঙ্গে গ্রাম ছাড়া হতে হয় ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু সিপিএম সমর্থকের পরিবারকেও।

নৃশংস এই ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত আশরাফ। ঘটনার পর দিন থেকেই পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’ বছর চৌত্রিশের এই যুবক। তবে তিনি গ্রাম ছেড়ে কখনও কোথাও যাননি। তাঁর ভয়েই বেশ কয়েক মাস ধরে গ্রামে ঢুকতে পারছেন না প্রায় তিনশো সিপিএম সমর্থক। হৃদয়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের এই গ্রামে চারটি বুথেই তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দলের এজেন্ট নেই।

ভোট তাই যেমন হওয়ার, তেমনই হল। সকাল ন’টা নাগাদ বুথে গিয়ে দেখা গেল বাইরে পুরুষ-মহিলার হালকা লাইন। ভোট দেওয়ার ব্যপারে তাদের বিশেষ তাড়া আছে বলে মনে হল না। ভিতরে একমাত্র এজেন্ট ওসমান আলি শাহ আলস ভঙ্গিতে বললেন,‘‘আমাদের গ্রামের সকলেই তৃণমূল সমর্থক। তাই অন্য দল এজেন্ট পায় না। ভোট কিন্তু শান্তিতেই হচ্ছে।’’

একই পরিস্থিতি পাশের বুথেও। সেখানেও কেবল মাত্র তৃণমূলের এজেন্ট। আশরফের খোঁজ করতেই গাছ তলায় বসে থাকা এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘ভাইকে কেন এখানে থাকতে হবে। সকালে একবার ঘুরে গিয়েছে। ওতেই হয়ে যাবে। সকলে বুঝে গিয়েছে কাকে ভোট দিতে হবে। তাছাড়া আমরা তো আছি।’’

সিপিএম-এর জেলা কমিটির সদস্য তথা চাপড়ার প্রাক্তন বিধায়ক সামশুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘‘নিহতের পরিবার-সহ বেতবেড়িয়া গ্রামের প্রায় তিনশো জন সিপিএম কর্মী ঘটনার পর থেকে এলাকাছাড়া। আমরা যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম তাদের নাম প্রশাসনকে দিয়েছিলাম।” সিপিএম-এর বারবার আবেদনের ভিত্তিতে সপ্তাহখানেক আগে গ্রামছাড়াদের ফিরিয়ে আনার জন্য এই গ্রামে সর্বদল বৈঠক করেছিলেন জেলাশাসক, পুলিশ সুপার-সহ জেলার পুলিশ-প্রশাসনের একাধিক কর্তা। সেখানেই ঠিক হয় ভোটের আগে গ্রামে ফিরবেন গ্রামছাড়ারা। জেলাশাসক পি বি সালিম বলেন, ‘‘আমি ও পুলিশ সুপার দু’জনে ওই গ্রামে গিয়ে বৈঠক করে এসেছি। সিপিএম থেকে ৩৪ জনের একটা তালিকা দেওয়া হয়েছিল। তাদের গ্রামে ঢুকতে যাতে কোনও সমস্যা না হয় তার সব রকম ব্যবস্থা আমরা করেছিলাম।’’

প্রশাসনের এই আশ্বাসের পরেও গ্রামে ফিরলেন না কেন?

স্কুল ভোটে নিহত সিপিএমকর্মী আশাদুল শেখের বৌদি মরিচা বিবি বলেন, ‘‘প্রশাসন যতই বলুক গ্রামে ঢুকলে খুন হয়ে যেতে হবে। আশরাফ আমাদের খুন করবে বলে হুমকি দিয়েছে। সকলের সামনে আমার দেওরকে কুপিয়ে খুন করল আশরফ। অথচ পুলিশ তাকে ধরল না। কার ভরসায় গ্রামে ঢুকব বলতে পারেন?’’ গ্রামছাড়া সিপিএম কর্মী সজিম আলি শাহও বলেন, “গ্রামে ঢুকলেই খুন করে দেবে আশরাফ। এত বড় একটা ভোট হল। অথচ অমি আমার মতটা জানাতে পারলাম না। বিষয়টা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।’’

নিহতের পোড়া বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন দীর্ঘ দিন পরে বাড়ি ফেরা এক বৃদ্ধা। নখের কালি দেখিয়ে তিনি বলেন,‘‘অনেক সাহস করে এবার ভোট দিতে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম আমি বুড়ি মানুষ, আমাকে অন্তত আশরফের লোকেরা কিছু বলবে না। ওরা আমাকে বুথের ভিতরে নিয়ে গেল। নখে কালিও দিল। কিন্তু ভোটটা আমাকে দিতে দিল না। গ্রামের একটা ছেলে বোতামটা টিপে দিয়ে আমাকে বের করে দিল।’’

‘শান্তির ভোট’ এই ভাবেই হয়। ‘শান্তির ভোট’ এই ভাবেই হল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

susmit haldar chapra ashraf sheikh tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE