Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বেপাড়ার নুরুলকে রুখতে বাবু ছুটছেন

রক্তবীজের ঝাড় সব! এখনই তুলে ফেলে দে! পিতাশ্রী-নির্মিত সাধের বাড়ির দেওয়ালের এক কোণের দিকে তর্জনী তুলে মালিকে নির্দেশ দিলেন গৃহকর্তা। কার্বলিক অ্যাসিডের বোতল আর কাটারি হাতে মালি যতক্ষণে দেওয়াল ফুঁড়ে গজানো অশ্বত্থ চারার দিকে এগোচ্ছেন, তাঁর ‘বাবু’র গাড়ি তখন ‘জঙ্গিপুর ভবনে’র ফটক পেরিয়ে পলসন্ডার দিকে ছুটেছে। রাজনীতিক সুলভ সামনের সিট নয়, এসইউভি-র পিছনের আসনে বসে মোবাইলে একের পর এক জন্মদিনের শুভেচ্ছার উত্তর দিচ্ছেন অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়।

সন্দীপন চক্রবর্তী
জঙ্গিপুর শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩১
Share: Save:

রক্তবীজের ঝাড় সব! এখনই তুলে ফেলে দে!

পিতাশ্রী-নির্মিত সাধের বাড়ির দেওয়ালের এক কোণের দিকে তর্জনী তুলে মালিকে নির্দেশ দিলেন গৃহকর্তা। কার্বলিক অ্যাসিডের বোতল আর কাটারি হাতে মালি যতক্ষণে দেওয়াল ফুঁড়ে গজানো অশ্বত্থ চারার দিকে এগোচ্ছেন, তাঁর ‘বাবু’র গাড়ি তখন ‘জঙ্গিপুর ভবনে’র ফটক পেরিয়ে পলসন্ডার দিকে ছুটেছে। রাজনীতিক সুলভ সামনের সিট নয়, এসইউভি-র পিছনের আসনে বসে মোবাইলে একের পর এক জন্মদিনের শুভেচ্ছার উত্তর দিচ্ছেন অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়।

প্রচারের ঠেলায় পড়ে জন্মদিনটাও নিজের মতো কাটানোর উপায় নেই রাষ্ট্রপতি-পুত্রের! “রোদ-গরম-আর্দ্রতা-ধুুলোয় ভরা এই জীবনটা আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। ঠিকই আছে!” নির্বিকার প্রতিক্রিয়া জঙ্গিপুরের দেড় বছরের সাংসদ এবং কংগ্রেস প্রার্থীর। কিন্তু সব কি ঠিকই আছে? মাত্র আড়াই হাজার ভোটে জেতা একটা আসন। প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হয়ে যাওয়ার পরে উপনির্বাচনে তৃণমূল যেখানে ময়দানেই ছিল না, এ বার গ্রামে গ্রামে তাদের উপস্থিতি দৃশ্যমান। দেড় বছর আগে ৮০ হাজারের উপরে ভোট পেয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া বিজেপি তো আছেই, বোঝার উপরে শাকের আঁটি হয়ে আরও তিন ছোট দলের প্রার্থীও আছেন। ভোট কাটাকাটির এই বাজারে সামান্য এ দিক-ও দিক মানেই তো দিল্লির ইনিংসে ইতি! “তৃণমূলকে দিয়ে এখানে কিছু হবে না! আমি জানি, আমাকে সিপিএমকে হারাতে হবে। ব্যস!” এ বারও নিষ্কম্প শোনাল সাংসদের কণ্ঠ!

পঞ্চায়েত ভোটে জঙ্গিপুর এলাকায় গোটা মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যে কংগ্রেসের ফল সব চেয়ে ভাল এবং অধীর চৌধুরীর হাতে পড়ে কংগ্রেসের সংগঠন আগের চেয়ে চাঙ্গা এই দুই ফ্যাক্টরকে নিজের পক্ষে ধরে রেখেছেন প্রাক্তন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু জঙ্গিপুরের অদূরে দেউলির দশাসই ভিটে থেকে পলসন্ডা, মেহন্দিপুর হয়ে নবগ্রামের ভিতরে অমৃতকুণ্ড পর্যন্ত যে অভিজিৎকে দেখা গেল, তাঁর সঙ্গে লোকলস্কর বিশেষ নেই। জঙ্গিপুুরে প্রার্থী প্রণববাবুর সময়কার জৌলুস এবং উদ্দীপনার কোনও ছায়াও নেই তাঁর পুত্রের বেলায়। প্রচারে বেরিয়ে পাঁচ রকম আবদার, দাবির সম্মুখে কোনও প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন না বর্তমান সাংসদ। বলছেন, এখন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কোনও অর্থই হয় না। বরং, ভোটে জিতে এলে তখন এ সব নিয়ে ভাবতে হবে!

গোটা জঙ্গিপুরে জনশ্রুতি যে, একটু যদি মিশুকে হতেন কংগ্রেস সাংসদ, তাঁর জন্য জান কবুল করে নামতে পারতেন আরও অনেকে! কিন্তু ঘটনা হল, জঙ্গিপুরের ‘বাবু’ আসলে সোজা কথা স্পষ্ট বলতে ভালবাসেন। ‘রাষ্ট্রপতি-রাষ্ট্রপতি’ কথাটা তাঁর সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকা যে সত্যিই ঈষৎ চাপের কারণ, অস্বীকার করেন না। বাঙালি-সুলভ আবেগের মোড়কে কূটনৈতিক জবাব তাঁর ধাতেও নেই! পরিষ্কার বলতে পারেন, “সবাই আমাকে চাইবেন, এটা না-ও হতে পারে। কিন্তু মানুষ যেটা চাইবেন, সেটা প্রকাশ করার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমার লড়াই। বোমা-গুলি নিয়ে রাজনীতি করি না, পুুলিশকে পেটো মারতে বলি না! মানুষ নিজের মত দেবেন। তার পরে যা হওয়ার, হবে!” জঙ্গিপুরে জেতার পরে হাতে-কলমে ১৪ মাস পেয়ে যতটুকু কাজ করা যায়, চেষ্টা করেছেন। সাফ যুক্তি তাঁর।

মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দিয়ে চতুুর্দিকে তৃণমূলের পোস্টার পড়েছে, ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রকে আলোকিত করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য নুরুল ইসলামকে ভোট দিন’। কোন নুরুল? বসিরহাটের গত বারের তৃণমূল সাংসদ। কেন্দ্র বদলে দলনেত্রী তাঁকে পাঠিয়েছেন প্রণব-তালুকে কংগ্রেসের মহড়া নিতে! যার ফলে জঙ্গিপুরই হয়েছে রাজ্যের একমাত্র লোকসভা আসন, যেখানে একসঙ্গে দুই বিদায়ী সাংসদ লড়াইয়ে আছেন! নিজের ‘তৃণমূল’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসিরহাট থেকে নিজস্ব টিম এনে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে একটা হোটেলে ডেরা বেঁধেছেন শাসক দলের সাংসদ।

“যাই, এ বার চৈতন্য-রথে উঠতে হবে” বলে যেখানে নিজের গাড়ি ছেড়ে রোড শো-র জন্য খোলা ভ্যানে উঠে গিয়েছিলেন অভিজিৎ, সেই নবগ্রামেরই অন্য প্রান্তে ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে নাচতে নাচতে গিয়ে আছড়া গ্রামের মসজিদ থেকে বেরোনোর মুখে ধরা গেল হাজি নুরুলকে! “এখান থেকে তো এত মহামানব সাংসদ হয়েছেন! রাস্তার এই হাল কেন? বসিরহাটে বিড়ি শ্রমিকদের জন্য লড়াই করে ১২৭ টাকা পর্যন্ত মজুরি হয়েছে। এখানে ৯৫ টাকায় আটকে কেন?” জানতে চাইলেন নুরুল। বোঝা গেল, হোমওয়ার্ক সেরে নেমেছেন! বস্তুত, সরু রাস্তা এবং জলের সমস্যার প্রতিবাদে রঘুনাথগঞ্জের সাদিকপুরে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে রোড-শো বন্ধ রেখে এক বার ফিরেও যেতে হয়েছে কংগ্রেস সাংসদকে। কংগ্রেসের অভিযোগ, তৃণমূল পরিকল্পনামাফিক এ সব ঘটাচ্ছে। আর তৃণমূল প্রার্থী মনে করছেন, এলাকার মানুষের মনের কথা তাঁরা বুঝে নিয়েছেন। নুরুল যেমন বোঝালেন, “প্রথমে ভেবেছিলাম, কিছুই করতে পারব না! কিন্তু এখন দেখছি, বসিরহাটের থেকেও এখানে মানুষ বেশি আপন করে নিয়েছেন!”

কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে তো টাকা ছড়িয়ে ভোট কেনা এবং বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনছে বিরোধীরা! এ বার নুরুলের ভারী হাত আছড়ে পড়ল সামনের চেয়ারে। “পায়ের তলায় জমি হারিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণে নেমেছে ওরা! কোনও ফুটেজ আছে এ রকম? কোনও দিন কেউ আমার বিরুদ্ধে কোনও উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ আনতে পেরেছে? কোথাও এফআইআর, মামলা হয়েছে আমার নামে, দেখাতে পারবেন?” নুরুলের যুক্তি, মোট ভোটারের ৭২% যেখানে সংখ্যালঘু, এমন এক কেন্দ্রে তাঁকে সংখ্যালঘুদের কথা বলতেই হবে। সঙ্গে আরও যোগ করছেন, “মহারাজদের অনুরোধে রামকৃষ্ণ মিশনে, বসিরহাটে হিন্দু মিলন মন্দিরের উন্নয়নে টাকা দিয়েছে এই নুরুল ইসলাম! উন্নয়ন ছাড়া কিছু নিয়ে ভাবিনি! বসিরহাটে একটা কাঁচা রাস্তা দেখাতে পারলে নির্বাচন থেকেই সরে যাব!”

সাগরদিঘির রাজমিস্ত্রি আব্দুল হামিদের মতোই বিজেপি প্রার্থী সম্রাট ঘোষ অবশ্য জানতে চাইছেন, এতই যদি করেছেন, বসিরহাট ছেড়ে আসতে হল কেন? রঘুনাথগঞ্জে মিছিল শেষে ম্যাকেঞ্জির মাঠে ২৯ বছরের ঝকঝকে তরুণ সম্রাট বলছিলেন, “এত উন্নয়ন হলে বসিরহাটের মানুষেরই তো উচিত ছিল সাংসদকে ওখান থেকে যেতে না দেওয়া!” সম্রাট জানাচ্ছেন, কোনও ফাঁকা প্রতিশ্রুতি নয়। কংগ্রেস-বাম-তৃণমূলের পরে বিজেপি-কে এক বার সুযোগ দেওয়ার বিনম্র আবেদন নিয়েই তাঁরা মানুষের কাছে যাচ্ছেন।

আর চতুর্মুখী বা বহুমুখী লড়াইয়ের অঙ্ক মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে চরকি পাক খাচ্ছেন সিপিএমের মুজফ্ফর হোসেন। এক একটা রাত কাটাচ্ছেন এক একটা গ্রামে। উপনির্বাচনের আড়াই হাজারের ঘাটতি দূর করতে এক একটা এলাকায় দু’বার-তিন বার করে ঘুরছেন। লালগোলার পাইকপাড়ায় দেখা হল যখন, দিনের আলো নষ্ট করতে চান না বলে দাঁড়ানোর সময় নেই! খোলা ভ্যান থেকে দু’আঙুল তুলে জনতাকে শুধু বলছেন, “গুছিয়ে থাকুন। চেষ্টা করুন!” বিড়ি শ্রমিকের মজুরি, চাষির ফসলের দাম আর ভাঙন দুর্গতদের সাহায্য, এই তিন দাবি তাঁর। বহুমুখী লড়াইয়ের ফায়দা পাবেন? মুজফ্ফর বলছেন, “সুবিধা-অসুবিধা কিছু নেই। কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি তিন পক্ষের বিরুদ্ধে আমার লড়াই। লড়তে হচ্ছে কার্যত রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধেও!”

লালগোলা থেকে সূতি, সর্বত্রই আলোচনা নুরুল এবং সম্রাট কত ভোট পাবেন, তার উপরে অনেকটাই নির্ভর করবে জঙ্গিপুরের ভাগ্য! তা ছাড়াও কাঁচি নিয়ে (এটাই প্রতীক) ভোট কাটতে তৈরি আছেন ডব্লিউপিআই-এর স্থানীয় প্রার্থী মনিরুল ইসলাম। তাতে আরও হাওয়া দিতে সিলিং ফ্যান নিয়ে আছেন এসডিপিআই-এর সাহাবুদ্দিনও!

রাষ্ট্রপতির শখের বাড়ির বর্তমান গৃহকর্তা ঠিকই নজর করেছেন! চেনা দেওয়ালে উঁকি দিচ্ছে কিছু শেকড়! ঝাড় উপড়ে ফেলতে ঝাঁ ঝাঁ রোদে তাই বেশিই দৌড়চ্ছে চৈতন্য-রথ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

lok sabha election sandipan chakraborty jongipur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE