Advertisement
০৩ মে ২০২৪

মুম্বইয়ে পাচার থেকে বাঁচল বেলডাঙার ছাত্রী

চরম দারিদ্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে বাড়ি থেকে স্কুলের পোশাক পরেই বেরিয়ে পড়েছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রুবিনা (নাম পরিবর্তিত)। ব্যাগের ভিতরে ভরে নিয়েছিল মাত্র একটা চুড়িদার-কামিজ। শিয়ালদহগামী লালগোলা প্যাসেঞ্জারের একটি কামরায় তাকে বসিয়ে দিয়ে মাসি চলে যায় পাশের কামরায়।

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৪ ০১:৩৪
Share: Save:

চরম দারিদ্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে বাড়ি থেকে স্কুলের পোশাক পরেই বেরিয়ে পড়েছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রুবিনা (নাম পরিবর্তিত)। ব্যাগের ভিতরে ভরে নিয়েছিল মাত্র একটা চুড়িদার-কামিজ। শিয়ালদহগামী লালগোলা প্যাসেঞ্জারের একটি কামরায় তাকে বসিয়ে দিয়ে মাসি চলে যায় পাশের কামরায়। কিন্তু ট্রেন যত এগিয়েছে, মা আর ছোট ভাইয়ের জন্য ততই হুহু করে উঠেছে রুবিনার বুকটা। তাকে কাঁদতে দেখে সন্দেহ হয় এক সহযাত্রীর। তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন যে, কিশোরী মেয়েটি কাজের সন্ধানে চলেছে মুম্বই। সব শুনে সাহজাহান শেখ নামে ওই ব্যক্তি ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করেন রুবিনা গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্যকে। ফোন করেন নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিমকে। মূলত তাঁরই উদ্যোগে ট্রেন থেকে উদ্ধার হয় রুবিনা। জেলাশাসক জানিয়েছেন, ওই কিশোরীর গ্রাম থেকে প্রায় ১০টি মেয়ে কাজের সন্ধানে বাইরে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে।

জেলাশাসকের সামনে দাঁড়িয়ে রুমিয়া পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, সংসারে ভয়ঙ্কর অভাবের কারণেই সে পাড়ি জমিয়ে ছিল মুম্বই-এর উদ্দেশ্যে। তবে সুযোগ পেলে সে কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে গিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। রুবিনার ইচ্ছার কথা জেনে জেলাশাসক। যোগাযোগ করেন কৃষ্ণনগরের কুইন্স গার্লস হাইস্কুল কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে। স্কুলটি আবাসিক। সেই আবাসনে থেকে পড়ার ব্যবস্থা করে দেন তিনি। এদিনই রুবিনাকে স্কুলে নিয়ে যায় প্রশাসনের কর্মীরা। স্কুলের প্রাধানশিক্ষিকা মহুয়া সরকার বলেন, ‘‘ওই মেয়েটির যাবতীয় খরচ যদি প্রশাসন বহন করে তাহলে তাকে রাখতে আমাদের কোনও সমস্যা নেই।’’ রুবিনার পড়ার ক্ষেত্রে যে অর্থের কোন সমস্য হবে না সে কথা জানিয়ে দিয়ে জেলাশাসক বলেন, ‘‘ওই ছাত্রীটির খরচ প্রশাসনই দেবে সর্বশিক্ষা মিশনের টাকা থেকে।”

রুবিনার বাড়ি মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থানার সারগাছি-সুতিহাটা গ্রামে। তারা চার বোন, এক ভাই। রুবিনার মাকে বছর দু’য়েক আগে তালাক দিয়ে দেন তার বাবা। জেলা শাসক পি বি সালিম বলেন, ‘‘মেয়েটির সংসারে প্রচন্ড অভাব। মা বিড়ি বেঁধে কোনও মতে সংসার চালান। অভাবের সুযোগ নিয়ে তাকে মোটা টাকার কাজের প্রলোভন দেখিয়ে মুম্বইতে ফুসলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তার মাসি। ট্রেনে মেয়েটিকে দেখে এক যাত্রীর সন্দেহ হওয়ায় তিনি আমাকে ফোন করে জানান। তার পরই তাকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করা হয়।’’

প্রথমেই জেলাশাসক যোগাযোগ করেণ রেল পুলিশের সঙ্গে। তার পরে শিশু সুরক্ষা দফতর ও একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীদের পাঠানো হয় কৃষ্ণমগর স্টেশনে। তারাই ওই কিশোরীকে ট্রেন থেকে উদ্ধার করে জেলাশাসকের কাছে নিয়ে আসেন।

অভাবী সংসারের মেয়েরা প্রায়ই পাচারচক্রের শিকার হচ্ছে। জেলাশাসক বলেন, ‘‘ওই মেয়েটির এক দিদি বছর দু’য়েক আগে মুম্বইতে গিয়েছিল কাজ করতে। এখন আর তার কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। একই ভাবে এই মেয়েটিকেও পাচার করে দেওয়া হত। সব চাইতে বড় কথা ওই গ্রাম থেকে এই ভাবে প্রায় দশজন মেয়ে নাকি বাইরে গিয়েছে কাজের জন্য।’’

এদিন জেলা শাসকের চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে রুবিনা বলে, ‘‘সংসারে খুব অভাব। প্রতিদিন ঠিক মতো খাওয়াও হয় না। মাসি আমাকে বলল যে তাঁর সঙ্গে মুম্বইতে কাজে গেলে অনেক টাকা মাইনে পাব। আমি ভাল থাকব। ভাল থাকবে আমার বাড়ির সবাই। তাই আমি মাসির সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।’’ মাসি তাকে ট্রেনের কামরায় তুলে দিয়ে পাশের কামরায় ওঠে। ঠিক হয় শিয়ালদহে নেমে তাদের আবার দেখা হবে। কিন্তু ট্রেন যত এগিয়েছে, ততই বাড়ির জন্য, মায়ের জন্য, ছোট ভাইটার জন্য বুকের বিতরটা হুহু করতে থাকে। এক অজানা আশঙ্কায় কেঁদে ফেলে সে। পাশেই বসেছিলেন মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বাসিন্দা সাহজাহান শেখ। কান্না দেখে সন্দেহ হয় তাঁর। রুবিনা বলে, ‘‘ভাগ্যিস কেঁদে ফেলেছিলাম। তাই তো এত বড় একটা বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেলাম। পড়ার সুযোগ পেলাম।’’

যাঁর তৎপরতায় এদিন রুবিনা রক্ষা পেল, সেই সাহজাহান শেখ সিপিএম-এর বেলডাঙা-৩ লোকাল কমিটির সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘‘মেয়েটা কাঁদছে দেখে সন্দেহ হয়। সব শুনে বুঝতে পারি যে মেয়েটা কঠিন বিপদে পড়তে চলেছে। তখনই আমি নদিয়ার জেলা শাসকের ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করি।’’ খবর পেয়ে ছুটে আসে রুমিয়ার দিদি। এরই মধ্যে রুবিনার জন্য কেনা হচ্ছে নতুন জামা, জুতো, বই। ভাল থাকার স্বপ্ন এই ভাবে সত্যি হবে, ভাবেনি রুবিনা।

(সহ প্রতিবেদন: সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mumbai trafficking girl student beldanga
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE