নারদ-কাণ্ডে ‘নিরপেক্ষ’ তদন্ত, নেতৃত্বে নগরপাল!

পৃথক তিনটি অভিযোগের ভিত্তিতে নারদ স্টিং অপারেশন নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা চলছে। ওই অপারেশনের ফুটেজ সত্যি কি না, তা জানতে ফরেন্সিক পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। পাশাপাশি লোকসভার ‘এথিক্স কমিটি’ও স্টিং অপারেশনের সত্যতা খতিয়ে দেখছে। এরই মধ্যে শুক্রবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, রাজ্য সরকার নারদ স্টিং অপারেশনের তদন্ত করবে। তদন্তকারী দলের নেতৃত্বে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার।

এ দিন সারা দিন বিধানসভায় কাটিয়ে বিকেল ৫টা নাগাদ নবান্নে ঢোকেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরেই মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে-কে নিজের ঘরে ডেকে নেন। ঘণ্টাখানেক আলোচনার পরে রাত ৮টা নাগাদ মমতা বলেন, ‘‘আজকে আমি মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে দীর্ঘ ক্ষণ আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, নির্বাচনের সময় বিশেষ করে একটি স্টিং অপারেশনকে কেন্দ্র করে যে ভাবে নানা রকম প্ররোচনা, উত্তেজনা ও চক্রান্তের তৈরি করা হয়েছিল এবং জনমানসে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, আমরা চাই এর সত্যতা উদ্ঘাটিত হোক।’’ মমতা বলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি, এর পিছনে চক্রান্ত, প্ররোচনা কিছু আছে। খুঁজে বের করা দরকার। এবং সেই জন্য আজ (শুক্রবার) আমি নির্দেশ দিয়েছি, মুখ্যসচিবের কাছে একটা নোট দিয়েছি, পুরো বিষয়টির পিছনে কী চক্রান্ত আছে, আসল সত্য কী, এটা উদ্ঘাটনের জন্য পুলিশি তদন্ত করতে বলেছি।’’

মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে পাশে দাঁড় করিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানান, আইন মতো ‘ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অ্যাকশন’, পুরোটাই নিতে বলা হয়েছে। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। সে কথা-ই রাখলাম। সত্য বের হোক।’’ তাঁর মতে, ‘‘আমার মনে হয়, চক্রান্ত করে বাংলার মুখ নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা চাই সত্য প্রকাশ হোক।’’ মমতা বলেন, ‘‘নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই স্বচ্ছতা রাখতে একটা কমিটি করে দিয়েছিলাম। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধায় এবং সুব্রত বক্সিকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তাঁরা অবশ্য সিদ্ধান্ত আমার উপরেই ছেড়ে দিয়েছিল।’’

মুখ্যমন্ত্রী জানান, বিধানসভা শুরু হলেও এর সঙ্গে কোনও যোগ নেই। তবুও এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি স্পিকারকে সব জানিয়েছেন, অনুমতিও নিয়েছেন— বলেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়, স্টিং কাণ্ডের ক্যাসেটটি জাল না আসল, জানা গিয়েছে? মমতা বলেন, ‘‘এ সব নিয়ে আমি কেন কথা বলব। সেটা তদন্তের উপর নির্ভর করছে। এটা ‘ম্যানুফ্যাকচারড’ কি না, তা তদন্তেই জানা যাবে।’’ এর পরে মুখ্যমন্ত্রীর সংযোজন, ‘‘আমি আপনার কাছে টাকা ঘুষ দিতে গিয়েছি না কেউ আপনার কাছে টাকা চেয়েছে—এ সব অনেক ব্যাপার আছে। টিভিতে বা চ্যানেলে ক্যামেরা ও মোবাইলে কেউ কোনও কথা বলছে, তা রেকর্ড করতেই পারেন। কিন্তু কোন প্রসঙ্গে কী কথাটা বলছে, সেটা তো দেখতে হবে। তা-ই বলছি অনেকগুলো দিক আছে। সেটা বুঝেশুনে পুলিশ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করুক।’’

আরও পড়ুন

‘শুরু হল আপনার আরও এক কলঙ্কিত অধ্যায়’, তীব্র আক্রমণে অধীর

বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি বলেছেন, ‘‘উনি (মুখ্যমন্ত্রী) মানুষকে বোকা ভাবেন। ভোটের আগে বললেন, নারদার কথা আগে জানলে টিকিটই দিতেন না। ভোটের পরে অভিযুক্তদের গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী করলেন। এখন মানুষের চোখে ধুলো দিতে তদন্তের নামে প্রহসন করছেন।’’ তারপরেও অবশ্য আদালতের রায়ের উপরে আস্থা রাখতে চান মান্নান। মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের তদন্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মান্নান বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কি আদালতের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না?’’

সিপিএমের আইনজীবী-নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এ রকম আজব তদন্ত কেউ কখনও শুনেছে? পুলিশ কমিশনার মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করবেন, বিশেষ করে যে মন্ত্রীরা পদাধিকারে তাঁর ঊর্ধ্বতন ও সেই মন্ত্রিসভার প্রধান স্বয়ং পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী!’’ বিকাশবাবুরও অভিযোগ, হাইকোর্টে যে মামলা চলছে, তাকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টায় এই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রর মন্তব্য, ‘‘নারদ-কাণ্ডে যাঁরা অভিযুক্ত তাঁরাই এখন তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছে এবং সেটাও পেটোয়া পুলিশ কর্তাকে দিয়ে! এটা প্রহসন ছাড়া আর কী?’’

বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কাকে দিয়ে তদন্ত করাবেন? তাঁর উপর মানুষের আস্থা আছে তো? ভোটের আগে উনি নারদ-কাণ্ড অস্বীকার করলেন, আর এখন তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছেন। এটা পুরোটাই লোকদেখানো।’’

নারদা নিউজের কর্ণধার ম্যাথু স্যামুয়েলও রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপকে বেআইনি আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিষয়টি কলকাতা হাইকোর্টে বিচারাধীন। আদালতই তদন্তকারী দল নিয়োগ করবে। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তদন্তের ঘোষণা শুধু অর্থহীন-ই নয়, বেআইনিও।’’ ম্যাথু জানান, নবান্নের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ জানাবেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্য সরকার এখন কোনও ভাবেই পৃথক তদন্তের নির্দেশ দিতে পারে না। আমি আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করছি।’’

আদালতের নথি বলছে, গত ১৬ মার্চ নারদ স্টিং অপারেশন নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে তিনটি জনস্বার্থে মামলা দায়ের হয়। প্রথম মামলাটি দায়ের করেন অক্ষয়কুমার সারেঙ্গী নামে হাইকোর্টেরই এক আইনজীবী। ওই দিনেই পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী ও আইনজীবী আবু আব্বাসউদ্দিনের তরফে দ্বিতীয় মামলাটি দায়ের হয়। করেন। বিকেলে তৃতীয় জনস্বার্থ মামলাটি দায়ের করেন বিজেপি নেতা ব্রজেশ ঝা। আদালতের কাছে আবেদনকারী সকলেরই আর্জি ছিল, নারদ-কাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হোক। মামলার শুনানি চলাকালীন প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ মন্তব্য করেছিল, সাধারণ মানুষেরও ওই ফুটেজের সত্যতা জানার অধিকার আছে।

এর পরে ৬ এপ্রিল ম্যাথু স্যামুয়েল ফুটেজ নিয়ে হলফনামা দায়ের করেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে। তার ভিত্তিতে ১২ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি তিন সদস্যের কমিটি গড়ে দেন ম্যাথুর কাছ থেকে ফুটেজ আনার জন্য। হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার, রাজ্য পুলিশের এক আইজি এবং সিবিআইয়ের এক এসপি-কে ওই কমিটির সদস্য করা হয়। আদালতের নথি বলছে, কমিটির সদস্যরা ওই ফুটেজ জোগাড় করে আদালতের হাতে তুলে দেন। ২৯ এপ্রিল সেই ফুটেজ ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠান। ঘটনাচক্রে এ দিনই আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, নারদ-মামলাটি গত ১০ জুন শুনানির তালিকায় ছিল। কিন্তু এ দিন নেই। কবে পরবর্তী শুনানি তা জানতে চান বিকাশবাবু। প্রধান বিচারপতি তাঁকে বলেন, দু’-এক সপ্তাহের মধ্যেই পরবর্তী শুনানি হবে।