গৌতম খাস্তগীর
ভিড়ের মধ্যে আচমকা খুব কাছ থেকে ‘মা’ ডাক শুনে চমকে ঘুরে তাকিয়েছিলেন সুতপা। বছর তিনেকের মেয়েটির চোখে কাউকে হারিয়ে ফেলার দৃষ্টি। সুতপা বুঝতে পারে মেয়েটি তার মা-কে খুঁজছে। পাশ থেকে এক মহিলার ডাক শুনেই মেয়েটি খিলখিল হেসে ছুটে যায়।
কিছুক্ষণের জন্য বদলে গিয়েছিল সুতপার চারপাশ। শপিং মলের ভিড়েও সুতপার চোখের জল বাধা মানেনি। একরত্তি মেয়েটির ‘মা’ ডাক সুতপাকে ফের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সেই প্রশ্নটির মুখে। তবে কী আর মা হওয়া যাবে না?
সেটা বছর তিনেক আগের কথা। তারপরে এক বছর ধরে চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি। আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে ভ্রণ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তাঁর গর্ভে। এখন সুতপার চোখে একরাশ স্বপ্ন। সুতপার ঘর আলো করেছে কয়েক মাসের ফুটফুটে শিশু। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে সুতপা নাম রাখবে গর্ভে ধারণ করা সন্তানের। শনিবার সুতপা বললেন, ‘‘আজকে মনে হচ্ছে, আগামীকালের মাতৃদিবস আমারই উদযাপনের জন্য। ছোট্ট মেয়েটার মুখে এখনও কথা ফোটেনি, কিন্তু আমি তো ওর দিকে তাকালেই দিব্যি ‘মা’ ডাক শুনতে পাই।’’
শুধু সুতপাই নন, উত্তরবঙ্গের অনেক মহিলার মা ডাক শোনার স্বপ্ন পূরণ করে দিয়েছে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। কলকাতা থেকে স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ গৌতম খাস্তগীর এখন নিয়মিত শিলিগুড়ি এবং মালদহে আসছেন। স্থানীয় কয়েকটি নার্সিংহোমের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গৌতমবাবুর সংস্থা কাজ করছেন। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার অসংখ্য মহিলা নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। শুধু গৌতমবাবুর সংস্থাই নয়, শিলিগুড়ির আরও কয়েকটি নার্সিংহোম এবং মালদহের বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ভ্রুণ প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে বন্ধ্যাত্বের নিরাময় ঘটছে।
মালদহের মহিলা কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষা চৈতালি চট্টরাজ বলেন, ‘‘এতদিন হয়ত মাতৃদিবসে নিঃসন্তান মহিলাদের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল বেশি গড়াত। এখন সে দিন গিয়েছে। এখন নিঃসন্তান মহিলাদের কাছে মাতৃদিবস স্বপ্ন নিয়ে আসে। বন্ধাত্ব নিরাময়ের আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ উত্তরবঙ্গে বসেই পাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আশা করছি এই চিকিৎসার সুযোগ সব জেলাতেই মিলবে।’’
চৈতালিদেবী জানেন, কিছুদিন আগেও আইভিএফ বা ভ্রুণ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়ে নানা কুসংস্কার কাজ করত। যদিও, সে সব কাটাতে বেশ কয়েক বছর ধরেই বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা প্রচার চালাচ্ছে। সেই সঙ্গে ভ্রুণ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে চিকিৎসার সুফল দেখেও অনেকে সংস্কারের বাধা কাটিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ গৌতম খাস্তগীর বলেন, ‘‘অতীতে দেখা যেত কলকাতা বা শহরের মহিলাদের মধ্যে এই চিকিৎসার সুযোগ নেওয়ার প্রবণতা ছিল। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। জেলা শহর, গ্রামের মহিলারাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। চিকিৎসা করাচ্ছেন। পরবর্তীতে সন্তানের সঙ্গে আনন্দে দিন কাটাচ্ছেন।’’
গৌতমবাবু জানান, বর্তমান জীবনযাপনের ধরণ, অত্যাধিক মানসিক চাপ, বয়স বেশি হয়ে যাওয়ার মতো কারণে বন্ধ্যাত্ব অথবা স্বাভাবিক ভাবে গর্ভধারণ করার সমস্যা হতে পারে। তার জন্য কোনও উদ্বেগের কারণ নেই বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি। আইভিএফ চিকিৎসার মাধ্যমে ভ্রুণ তৈরি করে মাতৃগর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়, তারপর স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই শিশুর জন্ম হয় বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
১৯৭৮ সালে এই পদ্ধতিতে রাজ্যে চিকিৎসা শুরু হয়। বিশেষজ্ঞরা জানান, এই চিকিৎসার শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডে। প্রাক্তন বিট্রিশ ফার্স্ট লেডি ৪৫ বছর বয়সে মা হয়েছেন। তেমনই এক অভিনেত্রী ৪১ বছর বয়সে মা হয়ে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিলেন। এখন অবশ্য বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে মা হওয়া বিলেতে নতুন নয়। রাজ্যেও এই চিকিৎসা ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়। কলকাতাতে ৫৯ বছর বয়সে এক মহিলা মা হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, ওই মহিলার ২৩ বছরের মেয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। তার পর থেকেই একাকিত্বের শিকার হয়ে পড়েছিলেন ওই মহিলা। আইভিএফ চিকিৎসার মাধ্যমে সন্তান লাভ করেন তিনি।
জলপাইগুড়ির এক নিঃসন্তান দম্পতি প্রথমে নানা তাবিজ-কবজ, প্রাথর্নার পরে আইভিএফ চিকিৎসা করিয়ে সন্তানের মুখ দেখেছেন। সে সময় তাঁরা কলকাতায় গিয়ে গৌতমবাবুর ক্লিনিকেই চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন ওই দম্পতি অন্যদের পরামর্শ দিয়ে শিলিগুড়ি বা মালদহে গৌতমবাবুর ক্লিনিকে পাঠাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এমন চিকিৎসার ক্ষেত্রে সময় লাগে তিন সপ্তাহ। চিকিৎসার খরচ সাধ্যের মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছেন এই রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
মালদহের একটি নার্সিং হোমের কর্ণধার চিকিৎসক দ্বিজেন সরকার বলেন, ‘‘আমাদের জেলার মহিলারাও এই চিকিৎসার ব্যাপারে উৎসাহিত হচ্ছেন। ৪৭ থেকে ৫০ বছর বয়সের মহিলারাও চিকিৎসার জন্য এখানে ছুটে আসছেন। আমাদের জেলাতে প্রাথমিক চিকিৎসা হচ্ছে।’’
প্রতিবছর মাতৃদিবসে অসংখ্য মায়েদের ফোন, শুভেচ্ছা পেয়ে থাকেন গৌতমবাবু সহ অন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এবারে মাতৃদিবসের আগে গৌতমবাবুর আশা শীঘ্রই উত্তরবঙ্গের সরকারি হাসপাতালেও এই চিকিৎসার সুযোগ মিলবে। মা ডাক শুনতে পাবেন স্বল্প আয়ের পরিবারের নিঃসন্তান মহিলারাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy