খাগড়াগড় মামলায় এ যাবৎ ধৃত ১৮ জনের মধ্যে দু’জনের সঙ্গে বিস্ফোরণ কাণ্ডের কোনও যোগ নেই বলে চার্জশিট পেশ করার সময়ে সোমবার আদালতে জানাল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। এ দিন ওই দু’জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিতেও আদালতে আর্জি জানান গোয়েন্দারা। ওই চার্জশিটে আট জন ফেরার-সহ ২১ জনকে অভিযুক্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে। অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের চার জন নাগরিক, যাদের মধ্যে কেবল গ্রেফতার করা গিয়েছে সাজিদ ওরফে শেখ রহমতুল্লাকে। হাতকাটা নাসিরুল্লা, কওসর, মহম্মদ ইউসুফের মতো জঙ্গি চক্রের মাথারা এখনও ফেরার। এই তিন জনও বাংলাদেশি।
গত ২ অক্টোবর বর্ধমানের খাগড়াগড়ে এক বিস্ফোরণে শাকিল গাজি ও করিম শেখ নামে দু’জন নিহত ও আবদুল হাকিম নামে এক জন জখম হয়। ওই ঘটনার সূত্রে গোয়েন্দারা পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ঝাড়খণ্ডে সন্ধান পান এক আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের, যার অগ্রভাগে রয়েছে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)। চার্জশিটে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্র করে মোট তিনটি রাজ্যে সন্ত্রাসের আঁতু়ড়ঘর তৈরি করেছিল বাংলাদেশি জেএমবি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার জন্যই এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল বলে এনআইএ-র দাবি।
বিস্ফোরণ কাণ্ডে প্রথম গ্রেফতারি হয় ৪ অক্টোবর। সেই হিসেবে ১৭৭ দিনের মাথায় এ দিন কলকাতা নগর দায়রা আদালতের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বিচারক গোপালচন্দ্র কমর্কারের এজলাসে ১৬৪ পাতার চার্জশিট পেশ করেন এনআইএ-র আইনজীবী শ্যামল ঘোষ। এখনও ২৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তকারীরা। পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ঝাড়খণ্ড মিলে শ’খানেক জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। সে সব নথি ও প্রমাণ এ দিন তিনটি বড় ট্রাঙ্কে ভরে আদালতে নিয়ে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরা।
মামলা থেকে কারা ছাড়া পাচ্ছেন?
এনআইএ জানিয়েছে, তাঁরা হলেন: বদরু আলম ওরফে হাসেম মোল্লা ও খালেদ মহম্মদ। বর্ধমানের পূর্বস্থলীর হাসেমকে বিস্ফোরণের অব্যবহিত পরে ও মায়ানমারের বাসিন্দা খালেদকে গত ১৮ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয়েছিল।
এনআইএ-র বক্তব্য, হাসেম মোল্লার সঙ্গে বিস্ফোরণ-কাণ্ডে জড়িত কয়েক জনের যোগাযোগের প্রমাণ মিললেও বিস্ফোরণ বা জঙ্গি কার্যকলাপে তার জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি। হাসেমকে গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশ। সেই গ্রেফতারি কি ভুল ছিল? এনআইএ-র এক অফিসার অবশ্য বলেন, ‘‘ওই অবস্থায় হাসেমের গ্রেফতারির মধ্যে কোনও ভুল ছিল না। বিস্ফোরণের কুশীলবদের সঙ্গে ওর টেলিফোনে কথাবার্তার প্রমাণ মিলেছিল।’’
আবার মায়ানমারের নাগরিক খালেদ ধরা পড়ে এনআইএ-র হাতে। তার ক্ষেত্রে গোয়েন্দাদের ব্যাখ্যা, জেএমবি-র যে চাঁইদের সঙ্গে খালেদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, তাদের কেউ এখনও ধরা পড়েনি। তবে খালেদের বিরুদ্ধে তেলঙ্গানার সাইবারাবাদ পুলিশ আগেই বিদেশি অনুপ্রবেশ ও নথি জালের মামলা রুজু করেছিল। খালেদকে তারা হেফাজতে নিতে আবেদন জানাবে।
ধৃত বাকি ১৬ জনের মধ্যে আবার তিন জনের নাম চার্জশিটে নেই। তারা হল: মুর্শিদাবাদের আবদুল ওয়াহাব মোমিন, নদিয়ার মতিউর রহমান ও অসমের বরপেটার রফিকুল ইসলাম। ওয়াহাবকে মাত্র দশ দিন আগে, এ মাসের ২১ তারিখ শিয়ালদহ থেকে গ্রেফতার করা হয়। এখনও সে এনআইএ হেফাজতেই।
কিন্তু অক্টোবরে ধৃত রফিকুলের নাম চার্জশিটে নেই কেন? বিশেষ করে তার সঙ্গেই অসমের আর যে দু’জনকে হেফাজতে পেয়ে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল এনআইএ, সেই শাহনুর আলম ও শাইকুল ইসলামের নাম কিন্তু অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছে! আবার গত ২৮ জানুয়ারি নদিয়ার মির্জাপুর গ্রামের গিয়াসউদ্দিন মুন্সি ও মতিউর রহমানকে এক সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। চার্জশিটে কিন্তু মতিউরের নাম নেই।
এনআইএ-র এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘আস্তিনে রাখা তাস আগেই দেখাব কেন? মতিউর ও রফিকুলের বিরুদ্ধে চমকে দেওয়ার মতো অনেক তথ্য আছে, যা আমরা সময় মতো সামনে আনব। তখনই সাপ্লিমেন্টারি চাজর্শিট দেওয়া হবে এদের বিরুদ্ধে।’’
গোয়েন্দারা জানান, একই কথা প্রযোজ্য দুই সন্দেহভাজন বাংলাদেশি সালাউদ্দিন সালেহিঁ ও রফিক, ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জের তারিকুল ইসলাম, বীরভূমের নানুরের মুস্তাফিজুর রহমান ও নদিয়ার থানারপাড়ার জহিরুল শেখ--- এই পাঁচ জনের ক্ষেত্রেও। এই পাঁচ জনের হদিস পেতে প্রত্যেকের জন্য ইনাম ঘোষণা করেছে এনআইএ। এমনকী, দিন সাতেক আগে জহিরুলের বাড়িতে গিয়ে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নোটিসও লটকে দিয়ে আসেন গোয়েন্দারা। অথচ পাঁচ জনের কারও নামই চার্জশিটে নেই।
তদন্তকারী সংস্থার এক কর্তার দাবি, নিজেদের জঙ্গি মতাদর্শকে ভারতে ছড়িয়ে বৃহত্তর ‘বাংলাদেশ’ তৈরির চেষ্টা করাটাই ছিল জেএমবি-র মূল লক্ষ্য। সে ক্ষেত্রে ভারতের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত। ওই গোয়েন্দাকর্তা বলছেন, ‘‘প্রাথমিক চার্জশিটে এ সব কথা নেই। কিন্তু পরবর্তী কালে এগুলোই হয় তো মুখ্য বিষয় হয়ে উঠবে।’’ তাঁর ইঙ্গিত, খাগড়াগড়ের এই ঘটনার সঙ্গে কী ভাবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস জাল জড়িত, পরবর্তী কালে অতিরিক্ত চার্জশিটে তা-ও উঠে আসতে পারে।
খাগড়াগড়ের তদন্তে নেমে এনআইএ এই রাজ্যে জামাতুল মুজাহিদিনের ঘাঁটি গড়ে ওঠার ঘটনা জানতে পারে। বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, নদিয়ায় বিভিন্ন বেআইনি মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে জঙ্গি প্রশিক্ষণের ডেরা গড়ে উঠেছিল, সেটাও এনআইএ তদন্তে উঠে আসে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এই মামলায় এখনও পর্যন্ত মোট ৩২ জনের নাম উঠে এসেছে। সেই হিসেবে চার্জশিটে নাম থাকা আট জন পলাতক ছাড়া আরও আট জন খাগড়াগড় কাণ্ডে ফেরার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy