Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

কুয়ো থেকে ব্যাগ উঠল, মিলল অপটিক কেবল

খাগড়াগড়ের সেই বাড়িতে মিলেছিল। শিমুলিয়ার মাদ্রাসা, বাবুরবাগের ডেরা, কীর্ণাহারেও মিলেছিল। এ বার মঙ্গলকোটে শিমুলিয়ার মাদ্রাসা-পরিচালক ইউসুফ শেখের শ্বশুরবাড়ি থেকেও পাওয়া গেল ফাইবার অপটিক কেব্ল। সেই তার, যা ব্যবহার করে চাইলেই ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটানো যায়। যে তার এক সময়ে মাওবাদী অধ্যুষিত লালগড়ে হামেশাই মিলত।

এনআইএ-র তল্লাশিতে বাজেয়াপ্ত সামগ্রী। শনিবার।  ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

এনআইএ-র তল্লাশিতে বাজেয়াপ্ত সামগ্রী। শনিবার। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

সৌমেন দত্ত ও মহেন্দ্র জেনা
বোলপুর ও মঙ্গলকোট শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৬
Share: Save:

খাগড়াগড়ের সেই বাড়িতে মিলেছিল। শিমুলিয়ার মাদ্রাসা, বাবুরবাগের ডেরা, কীর্ণাহারেও মিলেছিল। এ বার মঙ্গলকোটে শিমুলিয়ার মাদ্রাসা-পরিচালক ইউসুফ শেখের শ্বশুরবাড়ি থেকেও পাওয়া গেল ফাইবার অপটিক কেব্ল। সেই তার, যা ব্যবহার করে চাইলেই ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটানো যায়। যে তার এক সময়ে মাওবাদী অধ্যুষিত লালগড়ে হামেশাই মিলত।

শনিবার বীরভূমের মুলুকে ফেরার ডালিম শেখ এবং আরও দু’জনের বাড়ির কুয়ো থেকে তিনটি ভারী ব্যাগও পাওয়া গিয়েছে। ওই সব বাড়ির বাসিন্দাদের অ্যালুমিনিয়াম বাসনের ফেরিওয়ালা বলেই পাড়ার লোকে জানত। অথচ তল্লাশিতে পাওয়া গেল কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ এবং বেশ কিছু মোবাইল।

খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পর থেকেই ইউসুফ বেপাত্তা। স্ত্রী আয়েষা ও তিন সন্তানেরও খোঁজ নেই। এ দিন সকালে শিমুলিয়া থেকে কিলোমিটার দশেক দূরে পূর্ব নওয়াপাড়া গ্রামে ইউসুফের শ্বশুরবাড়িতে যায় এনআইএ এবং এনএসজি। দোতলা পাকা বাড়ি ও তার আশপাশে তল্লাশি চালিয়ে অপটিক কেব্ল ছাড়াও জেহাদি বই, কয়েকটি মোবাইলের সিম ও বেশ কিছু নথি মেলে। গোয়েন্দাদের মতে, জঙ্গিরা যে সব আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তৈরি করছিল, সেগুলির সঙ্গে এই ধরনের তার জুড়ে ল্যান্ডমাইন হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। যে তারগুলি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলির রং প্রায় মাটিরই মতো। ফলে মাটিতে পুঁতে দিলে সেগুলিকে আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল। তার এক প্রান্তে ডিটোনেটর জুড়ে দূর থেকে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটানো খুবই চালু পন্থা। দ্বিতীয় যে পন্থায় বিস্ফোরণ ঘটানো যায়, তা হল আইইডি-র সঙ্গে ‘টাইমার ডিভাইস’ লাগিয়ে দেওয়া। সে ক্ষেত্রে লম্বা তারের দরকার হয় না। খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরে ঘটনাস্থল থেকে ‘টাইমার’ পেয়েছিল পুলিশ। তার পরেই নানা জায়গা থেকে অপটিক কেব্ল মেলায় গোয়েন্দারা প্রায় নিশ্চিত যে দুই উপায়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর ছক কষছিল জঙ্গিরা। এনআইএ-র ডিএসপি পদমর্যাদার এক অফিসারের কথায়, “ এই ধরনের তার লালগড় এলাকায় মাওবাদীরা ব্যবহার করত। সেগুলি পরীক্ষার জন্য সিএফএসএলে পাঠানো হয়েছে।”

আগেই ইউসুফের পরিবার গোয়েন্দাদের জানিয়েছিল, বিস্ফোরণের পরেই সে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ে। তার তিন সন্তানকে পরে পূর্ব নওয়াপাড়ায় মামারবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ দিন ওই বাড়িতে অবশ্য কোনও শিশুর দেখা মেলেনি। জামাতউদ্দিনের দাবি, তারা তাঁর বাড়িতে আসেননি।

মুলুকের শান্তিপল্লিতে তিনটি কুয়ো থেকে উদ্ধার হওয়া ভারী ব্যাগে কী আছে, তা অবশ্য রাত পর্যন্ত জানা যায়নি। খাগড়াগড় কাণ্ডে অন্যতম সন্দেহভাজন কওসরের নাগাল পেতে তার ভায়রাভাই হবিবুরকেও খুঁজছে এনআইএ। সেই হবিবুরেরই ঘনিষ্ঠ শেখ ডালিমের বাড়িতে দুপুরে হানা তল্লাশিতে যান গোয়েন্দারা। বাড়িটিতে কেউ নেই। তালা ভেঙে ঢুকে বেশ কিছু আরবি বই, নথি, কয়েকটি মোবাইল ও ক্যালেন্ডার বাজেয়াপ্ত করে এনআইএ। ওই সব ক্যালেন্ডারে বিশেষ কয়েকটি তারিখের উপরে নীল কালিতে গোল দাগ দেওয়া ছিল।

এর পরেই স্থানীয় এক যুবককে ওই বাড়ির কুয়োতে নামান গোয়েন্দারা। উদ্ধার হয় প্লাস্টিকে মোড়া দু’টি ভারী ব্যাগ। আব্দুল মালেক, তালেহার শেখ ও হাফিজুর রহমান নামে আরও তিন বাসন বিক্রেতার বাড়িতেও হানা দেওয়া হয়। হাফিজুর বাড়িতে থাকলেও বাকি দু’টি বাড়ির বাসিন্দারা বেপাত্তা। এ দিন তালেহারের বাড়ির কুয়ো থেকে একটি ব্যাগ ওঠে। তিনটি বাড়ি থেকেই নথি, বই, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ, মোবাইল ফোন, ব্যাঙ্কের পাশবই, চেকবুক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। হাফিজুরের বাড়িতে একটি ভাঙা নম্বর প্লেট (ডব্লিউবি ৫৪-৬৬৭১) পড়ে থাকতে দেখে সেটি সম্পর্কেও খোঁজখবর নেওয়া হয়।

পাড়ার কিছু লোকজন গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন, ডালিমকে তাঁরা একাধিক ল্যাপটপ ব্যবহার করতে দেখেছেন। সে-ই তিনটি পরিবারকে এলাকায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। দু’বছর আগেই নিজের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল হবিবুর। কিন্তু ডালিমের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। হাফিজুরের মা রোশেনারা বিবি ও স্ত্রী রুহিদা বিবির সঙ্গে তদন্তকারীরা কথা বলেন। রোশেনারা পরে বলেন, “ওঁরা আব্দুল মালিক, তালেহার এবং হবিবুরের সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। কিন্তু আমরা তো কিছুই জানি না!”

পরে হবিবুরের মা জ্যোৎস্না বিবি, দিদি টুম্পা বিবি ও ভাই মতি শেখকেও জেরা করেন গোয়েন্দারা। তাঁরা বলেন, “হবিবুর ও তার স্ত্রী এক বার এ বাড়িতে এসেছিল। ও ফোন করত, কিন্তু আমরা করলে মোবাইল বন্ধ পেতাম, বা অন্য ভাষা শোনা যেত।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE