E-Paper

নদীর ভয়াল গ্রাসে দড়ি আঁকড়ে রক্ষা

বেলঘরিয়ার বাড়ি থেকে স্ত্রী আর ১২ বছরের ছেলেকে নিয়ে উত্তরবঙ্গে বেড়াতে যাই ষষ্ঠীতে। দার্জিলিং ঘুরে শনিবার সকালেই কার্শিয়াংয়ের তাবাকোশির একটি হোমস্টেয় উঠেছিলাম। এক দিন ওখানে থেকে আমাদের কলকাতায় ফেরার কথা ছিল।

শঙ্করপ্রসাদ রায়চৌধুরী (বিপন্ন পর্যটক)

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:২২
বৃষ্টিতে বিপর্যয়। পাহাড়ে ভেসে গেল গাড়ি। রবিবার দার্জিলিঙের মিরিকে।

বৃষ্টিতে বিপর্যয়। পাহাড়ে ভেসে গেল গাড়ি। রবিবার দার্জিলিঙের মিরিকে। —নিজস্ব চিত্র।

ঠিক যেন মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখে বেঁচে ফেরা! নদীর যে এত ভয়ঙ্কর রূপ হতে পারে, স্বপ্নেও ভাবিনি। পরিবার নিয়ে আবার সমতলে ফিরব, সকলের সঙ্গে যোগাযোগ হবে, এক মুহূর্তে বিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভোর রাতে কোনওমতে ভাঙা হোমস্টে থেকে দড়ি বেয়ে বেরোতে না-পারলে কী হত ভাবছি!

বেলঘরিয়ার বাড়ি থেকে স্ত্রী আর ১২ বছরের ছেলেকে নিয়ে উত্তরবঙ্গে বেড়াতে যাই ষষ্ঠীতে। দার্জিলিং ঘুরে শনিবার সকালেই কার্শিয়াংয়ের তাবাকোশির একটি হোমস্টেয় উঠেছিলাম। এক দিন ওখানে থেকে আমাদের কলকাতায় ফেরার কথা ছিল। নদীর পাড়ে অপরূপ পাহাড়-ঘেরা দোতলা বাড়ি। শনিবার দিনভর নদীর জলে পা ডুবিয়ে, নিশ্চিন্ত আয়েশে কাটিয়েছিলাম। রাতের বিভীষিকা তখন দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি!

শনিবার বিকেল থেকে ধীরে ধীরে মেঘ জমছিল। সন্ধের পরে বৃষ্টি শুরু হল। হোমস্টে-র আপ্যায়নকারীরা আশ্বস্ত করে বললেন, এমন বৃষ্টি হয়েই থাকে। রাতে খেয়েদেয়েও ভাবছিলাম, এই বুঝি সব ঠিক হবে! কিন্তু বৃষ্টির দাপট ক্রমশ বাড়ছিল। সেই সঙ্গে আকাশ-ফাটা মেঘের গর্জন। দোতলার ঘরে বৌ আর ছেলেটাকে আঁকড়ে সিঁটিয়ে বসেছিলাম। শুধু ভাবছিলাম, কখন রাতটা শেষ হবে!

কাছেই একটা ছোট্ট বাঁক নিয়ে নদীটি হোমস্টের সামনে বয়ে গিয়েছিল। নদী থেকে হোমস্টের দূরত্ব বড়জোর ২০-৩০ মিটার। রাতে নদীর জলস্তর বাড়তে বাড়তে সেই দূরত্ব কমছিল। প্রবল গর্জনে পাহাড় থেকে জল নেমে আসছিল। একটা সময় হঠাৎ দেখলাম নদী কোনও রকম বাঁক না নিয়ে পাহাড় ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘর থেকে কিছুটা দূরের বাঁকের মুখের হোমস্টের একাংশভেঙে জলের তোড়ে ভেসে যেতে দেখলাম। পরিস্থিতি ভয়ানক বুঝতে ভুল হয়নি। তড়িঘড়ি হাতের কাছের জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিই। আমাদের পাশের ঘরের আর একটি পরিবারও ভয়ে আমাদের ঘরে চলে এসেছিলেন তত ক্ষণে। নদীর জল তখন হু-হু করে আমাদের হোমস্টেয় ঢুকছে। জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে হোমস্টের সিড়ি। সকাল পর্যন্ত আর এখানে থাকা যাবে না বুঝতে পেরে যাই। হোমস্টের কর্মীরা দড়ির ব্যবস্থা করেন। বৃষ্টির মধ্যে একে একে সেই দড়ি ধরে কোনওমতে দোতলা থেকে নীচে নেমে আসি। আমার ছেলে, স্ত্রীকে নামানো হয়। এর পরে দিনের আলো ফোটা পর্যন্ত একটা শুকনো উঁচু জায়গায় মাথা গুঁজে ছিলাম। সকালের আলো আর কিছুটা বৃষ্টি কমতেই মিরিকের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করি। প্রায় সাত কিলোমিটার পাহাড়ি পথ হেঁটে পেরিয়েছি। তখম চার দিকে শুধুই ধ্বংসের ছবি। কোথাও বাড়ি ভেঙে পড়ে রয়েছে। কোথাও পাহাড় ধসে রাস্তা বন্ধ। চার দিকে শুধু জল আর জল। আমার মতো অনেকেই ব্যাগপত্তর নিয়ে হাঁটছে। এখনও বৃষ্টি হবে শুনছি। জানি না, কপালে আর কী আছে! আশা করি, মিরিকে নিরাপদেই থাকব।

অনুলিখন: চন্দন বিশ্বাস

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Flood in North Bengal North Bengal Weather Tourist

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy