Advertisement
E-Paper

অঙ্গনওয়াড়িতে সাফল্যের দাবি মালদহে

রতুয়ার এক বছরের নন্দলাল প্রামাণিকের হাত-পা দিন দিন কেমন যেন সরু হয়ে যাচ্ছিল। ছেলের এ হেন অবস্থা দেখে দিনমজুর বাবা বিকাশবাবুর মাথায় যেন বাজ পড়ে।

জয়ন্ত সেন

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৬ ০৮:০৭
ওজন নিয়ে চিকিৎসা চলছে শিশুর। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।

ওজন নিয়ে চিকিৎসা চলছে শিশুর। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।

রতুয়ার এক বছরের নন্দলাল প্রামাণিকের হাত-পা দিন দিন কেমন যেন সরু হয়ে যাচ্ছিল। ছেলের এ হেন অবস্থা দেখে দিনমজুর বাবা বিকাশবাবুর মাথায় যেন বাজ পড়ে। ছেলের চিকিৎসা কী ভাবে করাবেন তা নিয়ে ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না। মা সুমিত্রাদেবী স্থানীয় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে গিয়ে কর্মীকে বিষয়টি জানান। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ওই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, এই শিশু মারাত্মকভাবে অপুষ্টির শিকার। তিনিই নন্দলালকে নিয়ে এসে ভর্তি করেন পুরাতন মালদহের মৌলপুরে থাকা নিউট্রিশন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার বা পুষ্টি পুনর্বাসন কেন্দ্রে।

২৬ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত এখানে চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে নন্দলাল মায়ের সঙ্গেই বাড়ি ফেরে। ভর্তির সময় তাঁর ওজন ছিল ৪ কেজি ৪২০ গ্রাম, ছুটির সময় হয় ৫ কেজি ৭৯০ গ্রাম। এখন বিকাশবাবু বলছেন, পুষ্টি পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসার পরেই ছেলে সুস্থ হল। শুধু নন্দলালই নয়, এখান থেকে আনিষা বানু, প্রিয়াংশু দে সহ অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। এ ছাড়া অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি থেকেও পুষ্টিকর খাদ্য পেয়ে ও বাড়িতে স্রেফ খাদ্যাভাস পরিবর্তন করেই অপুষ্টিতে আক্রান্ত কয়েক হাজার শিশু সুস্থ হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, মালদহ জেলায় গত এক বছরে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা কমেছে প্রায় ২৫ হাজার। আক্রান্ত শিশুদের বয়স পাঁচ বছরের মধ্যে। যদিও জেলায় এখনও অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা রয়েছে ৫০ হাজারের কিছু বেশি। এর মধ্যে অবশ্য কম আক্রান্তের সংখ্যাই ৪২ হাজার। জানা গিয়েছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে চাঁচল মহকুমার মালতীপুর ব্লক হাসপাতালে আরও একটি নিউট্রিশন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার চালু করতে চলেছে স্বাস্থ্য দফতর।

জেলাশাসক শরদ দ্বিবেদী বলেন, ‘‘জেলায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা আমরা কমাতে চাইছি। সে কারণে সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প (আইসিডিএস) ও স্বাস্থ্য পরিষেবায় জোর দেওয়া হয়েছে। ওই ব্যাপারে আইসিডিএস ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে নিয়মিত পর্যালোচনা বৈঠকও করা হচ্ছে।’’ মালদহ জেলায় নানা কারণে ৫ বছর পর্যন্ত বয়সের শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক দিলীপ মণ্ডল বলেন, ‘‘গর্ভাবস্থায় মায়েদের পুষ্টির অভাব, অপূর্ণ ও কম ওজনের সন্তানের জন্ম, শিশুর জন্মের পর পুষ্টিকর খাবারের অভাব, জন্মের ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ না খাওয়ানো, কৃমি প্রভৃতি নানা কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে।’’ জেলা আইসিডিএস প্রকল্প দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে জেলায় ৫ বছর বয়স পর্যন্ত অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা ছিল ৭৪ হাজার ৭৪০ জন। এর মধ্যে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ছিল ১২ হাজার ৩৬০ জন ও কম আক্রান্ত ছিল ৬২ হাজার ৩৮০ জন। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা জেলায় কমে হয়েছে ৫০ হাজার ২৭৪ জন। ফলে গত এক বছরে কমেছে ২৪ হাজার ৪৬৬ জন। এর মধ্যে কম আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে ২০ হাজার ১৭৯ জন ও মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত থাকা ৪ হাজার ২৮৭ জন। যদিও এখনও পর্যন্ত জেলায় মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত যে ৮ হাজার ৭৩টি শিশু রয়েছে তাদের সংখ্যা বেশি রয়েছে কালিয়াচক ৩, চাঁচল ১ ও ২, হরিশ্চন্দ্রপুর ১ ও ২ প্রভৃতি ব্লকে।

গত এক বছরে জেলায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার কমে যাওয়ার ম্যাজিক প্রসঙ্গে জেলায় দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) দেবতোষ মণ্ডল বলেন, ‘‘জেলার ৫৫৭৩ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মী, স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীদের প্রচেষ্টাতেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা জেলার প্রতিটি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতি মাসে বা দু’মাস অন্তর স্বাস্থ্য শিবির করে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের চিহ্নিত করেছি।’’ তিনি জানান, এ ছাড়া মারাত্মকভাবে ভোগা শিশুদের পুরাতন মালদহের মৌলপুর ও কালিয়াচক ২ ব্লকের বাঙিটোলায় থাকা দুটি নিউট্রিশন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে ভর্তি রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই পুরো বিষয়টি নিয়েই জোরদার প্রশাসনিক নজরদারি ছিল। এ সব কারণেই পরিস্থিতি বদলেছে।

কী রকম পরিষেবা মিলছে মৌলপুর পুষ্টিবিকাশ কেন্দ্রে। মৌলপুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ঢুকতেই ডান হাতে পড়বে ওই কেন্দ্র। ঝাঁ চকচকে তিনটি ঘরে রয়েছে ১০টি বেড। মঙ্গলবার গিয়ে দেখা গেল, ১০টির মধ্যে ৯টিতে মারাত্মকভাবে অপুষ্টিতে ভোগা শিশু মায়েদের সঙ্গে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ওই শিশুদের সেখানে সেবা যত্ন করছেন দুই নার্স রুক্মিনী রায়, অগাস্টিন টুডু, এক অ্যাটেন্ডেন্ট অলি গোস্বামী (হালদার) ও এক সমাজকর্মী চিন্ময়ী দাস। অসীম শর্মা নামে এক চিকিৎসকও দুবার করে শিশুদের চেকআপ করে যান। কর্মীরাই বললেন, ‘‘সেখানে শিশুদের সকাল সাতটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত দু’ঘণ্টা অন্তর পর্যায় ক্রমে থেরাপিউটিক ফুড ও এফ-১০০ খাবার দেওয়া হচ্ছে। থেরাপিউটিক ফুডে রয়েছে বাদাম, শুকনো দুধ, নারকেল তেল ও চিনি দিয়ে তৈরি মণ্ড।’’ এফ ১০০-তে রয়েছে গরুর দুধ, রাইস অয়েল, চিনি ও সামান্য জলের মিশ্রণ। পেটের সমস্যায় ভোগা শিশুদের অবশ্য এফ ১০০-র বদলে দেওয়া হয় এফ ৭৫। তাতে গোরুর দুধ, রাইস অয়েল, চিনি, মুড়ির গুড়ো ও জলের মিশ্রণ রয়েছে। সকাল ১০টায় অবশ্য সকলকেই সবজি মেশানো খিচুড়ি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রয়েছে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ। মায়েদের জন্য রয়েছে আলাদা খাবার।

Anganwadi success
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy